কথিত আছে আন্দামান দ্বীপের নামকরণ হয় রামায়ণে বর্ণিত বানর দেবতা হনুমানের নাম অনুসারে :-
বেবি চক্রবর্ত্তী: হনুমান শব্দটি এসেছে হান্দুমান থেকে যার সংস্কৃত শব্দ হন- ("হত্যা") এবং মানা ("গর্ব") থেকে। অর্থাৎ হনুমান অর্থ "যাঁর গর্ব হত হয়েছে"।
হান্দুমান এটি মলয় ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে। যা প্রথমে হান্দুমান থেকে আন্দামান হয়েছে। অন্যদিকে- নিকোবর শব্দটির মলয় ভাষায় অর্থ হল নগ্নলোকের ভূমি।১৭৭৯ সালে ইংরেজরা নৌবহরে এসে আন্দামান দ্বীপে পৌঁছায়। আন্দামানের নিরিবিলি পরিবেশ,উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ,রঙিন জল,উন্মুক্ত নীল আকাশ ইংরেজ মেম সাহেবদের খুব পছন্দ হয়ে যায়।পরে ইংরেজ লাট সাহেবরা আন্দামানে তাদের নৌ-সেনাবহর,ইংরেজ কলোনি,অফিস ঘাট ইত্যাদি তৈরি করেন। তৎকালীন সময়ে ভারত সহ বার্মা, পুর্তগাল,সিঙাপুর,মালএশিয়া, ইন্দোনএশিয়া, প্রভৃতি দেশে ইংরেজদের উপনিবেশ ছিল। আন্দামানে ইরেজরা তাদের প্রভুত্ব থাকা দেশগুলি থেকে বিভিন্ন কয়েদি কে সাজা কাটানোর জন্য নিয়ে এসে আন্দামানের রাস্তা,ঘাট ইত্যাদি নির্মাণ করেন।
ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশে, যে সমস্ত লোকেরা নিজেদের স্বাধীনতার স্বার্থে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠত তাদের শায়েস্তা করার জন্য সাজা দিত। কিন্তু হলে কি হবে বিপ্লবীর রক্ত! রক্ত বীজের ন্যায় দেশের তরুণ দিকে স্বাধীনতার স্বার্থে গর্জে ওঠার আহ্বান জানাত। এই সমস্ত তরুণ বিপ্লবীরা ইংরেজের সাজার তোয়াক্কা না করে ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে,ইংরেজ শাসকদের দের রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধার কারণ হয়ে সামনে আসে।সেই স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের দেখে যাতে নতুন প্রজন্ম অনুপ্রেরণা না পায় তার জন্য ইংরেজরা বিপ্লবীদের সাথে সাধারণ মানুষের জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চাইছিল।
বিপ্লবী বন্দিদের আন্দামানের অন্যান্য দ্বীপে এনে রাখার পরামর্শ দেন। এরপর থেকে স্বাধীনতার স্বার্থে তরুণ বিপ্লবীদের দমনের জন্য ইংরেজরা ফাঁসি না দিয়ে
দ্বীপান্তর সাজা দেওয়ার প্রথা চালু করেন। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ সমুদ্রের মাঝে থাকায় সাধারণ মানুষ থেকে বিপ্লবী বন্দিদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।অন্যান্য দ্বীপে কয়েদিদের থাকার জন্য বস্তি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু আন্দামানে নোনা,স্যাঁতসেঁতে প্রতিকূল জলবায়ুর কারণে কয়েদীদের মৃত্যু হতে থাকে।
এরপর ইন্ডিয়ান ব্রিটিশ গভমেন্টের আদেশে ১৭৯৬ সালের পর থেকে আন্দামানে কয়েদীদের নিয়ে আসা বন্ধ করে দেওয়া হয়।পরবর্তী কালে ৬৯৩ কুঠুরি বিশিষ্ট বিশেষ জেল নির্মাণ করা হয়েছিল এবং একসঙ্গে অনেকগুলি সেল থাকায় এই জেলের নামকরণ করা হয় সেলুলার জেল।সেলুলার জেলের কুঠুরি গুলো এতো ছোটো করে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সেই কুঠুরির মধ্যে ০১ জনের বেশি কয়েদিকে রাখার জায়গা না থাকে।একটি কুঠুরি থেকে আর একটি কুঠুরির মধ্যে কোনো রকম জানালা রাখা হয়নি, যাতে করে একজন কয়েদি আর একজন কয়েদীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে না পারে।
জেলের কুঠুরির মধ্যে প্রবেশ দরজা ছাড়া কুঠুরির পিছনের দেওয়ালে ০৩ ফুট উঁচুতে একটি ছোট জানালা রাখা হয়েছিল তবে জানালা দিয়ে উত্তাল সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই দেখা যেতনা।কয়েদীদের জন্য আলাদা করে কুঠুরির মধ্যে টয়লেট করার জন্য কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা ছিলনা,কয়েদীদের শরীর খারাপ,পেট খারাপের মতো সমস্যা হলে
কুঠুরির মধ্যেই টয়লেট হয়ে গেলে ঐ একই ভাবে কয়েদীকে ময়লা নিয়েই রাত কাটাতে হত,পরের দিন সকালবেলা ছাড়া ময়লা পরিষ্কার করার আর আলাদা করে কোনো উপায় ছিল না।
তবে ফাঁসি সাজা প্রাপ্ত আসামিদের জন্য জেলের ভিতর স্পেশাল কন্ডোম সেলের ব্যবস্থা ছিল। কন্ডোম সেলে থাকাকালীন ফাঁসির আসামিদের সঙ্গে জেল কর্মীরা ভালো ব্যবহার করত,তাদেরকে ভালো খাবার দেওয়া হত আসামিদের উপর শারীরিক অত্যাচার করা হতো না।
এই জেল সম্বন্ধে বলতে হলে আর একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম না বললে অসসম্পুর্ণ থেকে যায়, তার নাম হলো বীর সাভারকার।। সাভাকর কে সেলুলার জেলে ১৯১১-১৯২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল। আপনারা জানলে অবাক হবেন সেলুলার জেলে বীর সাভাকরের ভাই
গণেশ সাভাকরকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল কিন্তু একই জেলে থাকা সত্ত্বেও তারা দুই ভাই এর একে অপরের সাথে দেখা হয় দশ বছর পরে।
তারা দুই জনের কেউ জানতনা যে তার দাদা ও ভাই একই জেলে বন্দি আছে। সেলুলার জেলে সাজা কাটার সময় বীর সাভাকরের অনুরোধে জেলের মধ্যে একটা ছোট গ্রন্থাগার খোলা হয়। সেলুলার জেলে ১০ বছর সাজা কাটার পর ১৯২১ সালে বীর সাভারকার কে মহারাষ্টের রত্নগিরি জেলে ০৩ বছরের সাজা কাটার জন্য স্থানান্তর করা হয়।
এইভাবে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সাভাকর রত্নগিরি জেলে সাজা কাটেন এবং বাকি ৫ বছর ইংরেজ সরকার কোনো রকম রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগাযোগ না রাখার শর্তে গৃহবন্দী হয়ে থাকার অবসর দেন। ১৯৮৬ সালে ৮৩ বছর বয়সে বীর সাভারকার মারা যান। সেলুলার জেলে বন্দিদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের তালিকার দীর্ঘ সূচি রয়েছে। তাঁদের মধ্যে-বীর সাভারকার, মাওলানা আহমদুল্লা,এস.চন্দ্র চ্যাটার্জী,এবং আমার পূর্ব বর্ধমান জেলার গর্ব আমার এলাকার (খন্ডঘোষের থানার বাসিন্দা) বটুকেশ্বর দত্ত প্রভৃতির নামও উল্লখযোগ্য। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে বাঙালিদের অবদানের কথা আগামী প্রজন্মের কাছে বিলুপ্তির পথে।
Comments
Post a Comment