রূপকথার ছড়ায় বাংলার করুন ইতিহাস

পার্থ মুখোপাধ্যায়: বিশ্বব্যাপী লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ জুড়ে আছে নানা রকম ছড়া। এই ছড়া গুলি যেন সেই সোনার কাঠি। যার অমোঘ স্পর্শে মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে রূপকথার জগৎ। লাল কমল নীলকমল, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি, আবার কখনো ভয়ংকর রাক্ষসের হাত থেকে রাজপুত্রের রাজকন্যা কে বাঁচিয়ে আনার গল্প -  ছোটবেলায় এই সমস্ত ছড়াগুলি শনেনি এমন মানুষ পাওয়া খুবই দুষ্কর। তবে সাহিত্যচর্চার মতো সুচিন্তিত ও সচেতন ভাবে কথা বসানো নয়, শব্দ চয়ন এখানে বড়ই স্বতঃস্ফূর্ত। মানুষ যেদিন থেকে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখেছে সেই দিন থেকেই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে এই সমস্ত ছড়া গুলি তৈরি হয়ে এসেছে। দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে একটা যুগ থেকে অন্য আরেকটা যুগে এইসব ছড়াগুলি সঞ্চারিত হয়ে এসেছে। গ্রামের সরল জীবন যাপন থেকে শুরু করে বাস্তবে দেখা জগত সবকিছুই এই ছড়ার মাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন কত নাম না জানা কবি, লেখক। 

এই ছড়াগুলো সাধারণত মানুষের মুখেই প্রচারিত হয়ে এসেছে। এইভাবে পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন এর মধ্য দিয়ে কখনো কনো অঞ্চল ভেদে বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন জায়গায় ক্রম বিবর্তন ঘটেছে। অনেকে মনে করেন ১৮৭৩ সালে ভাষাতত্ত্ববিদ স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন্ ইংরেজি অনুবাদ সহ যে বাংলা ছড়ার সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন সেটির ' দুগ্ধ মিঠা, চিনি মিঠা আর মিঠা ননী...' ছড়াটি বাংলা ছড়ার প্রাচীনতম সংগ্রহ। ১২৭১ বঙ্গাব্দে বা ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায় রচিত 'বিক্রম' নাটকে আমরা এই ছড়াটা পাই -  "নিমতেঁতো, কল্লা (করলা) তিতো, তিতো মাকাল ফল / তা হইতে অধিক তিতো দু' সতীনের ঘর'। তাহলে বলা যেতেই পারে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃত ছড়াটি হল বাংলা ভাষায় সংগৃহীত প্রাচীনতম মৌখিক ছড়ার নিদর্শন।

প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো অধিকাংশ ছড়াই ছিল নীতি মূলক, উপদেশ সূচক ও ভবিষ্যৎ গণনার দিকে নির্দেশিত। যেমন খনার বচনের ছড়াগুলো ভবিষ্যৎ নির্ধারণের পথপ্রদর্শক হয়ে আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েকশো বছরের বাংলার ইতিহাস ছিল রাজনৈতিক টানাপোড়নের ইতিহাস। যেমন '' শক,হুন, দল, পাঠান, মোঘল" থেকে শুরু করে ব্রিটিশ রাজশক্তির বাংলা দখল এই সমস্ত পালটে যাওয়ার সমাজ চিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছড়ার বিষয়বস্তু ও পালটে যেতে থাকে। তৎকালীন ছড়াগুলোর মধ্যে সেই সময়ের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক স্বরূপ ফুটে উঠেছে। তাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ছড়া গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। যে ছড়াগুলো একটা সময় আমাদের খেলা বা দুপুর বেলা শিশুদের ঘুম পাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার ছিল সেই রকম কিছু ছড়ার মর্মার্থ জানলে আমাদের অবাক হতে হয়। যেমন- 

“খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে।

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?

ধান ফুরল, পান ফুরল খাজনার উপায় কী?

আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।।

ধনিয়া পিঁয়াজ গেছে পচে সর্ষে ক্ষেতে জল।

খরা-বন্যায় শেষ করিল বর্ষ এর ফসল।।

ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি সব শুধু খালি।

ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে শত শত তালি।।” বাংলার লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া এই ছড়াটির মধ্যে লুকিয়ে আছে অষ্টাদশ শতকের বাংলায় মারাঠা শক্তি আক্রমণের ইতিহাস। ইতিহাসের পাতা ওল্ডালে দেখতে পাওয়া যায় ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকায় মারাঠা বর্গিরা লুটতোরাজ চালিয়ে এসেছে। এই 'বর্গি' শব্দটি এসেছে ফরাসি (মতান্তরে মারাঠি) শব্দ থেকে। যার অর্থ  "অশ্বারোহী মারাঠা যোদ্ধা"। বাংলায় আলিবর্দি খা'র শাসনকালে মারাঠা আক্রমণ ঠেকাতে খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। আলীরবর্দি খাঁ যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের পরিচয় দিলেও মারাঠা আক্রমন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তখন সমগ্র বাংলা জুড়ে মারাঠা সৈন্যরা সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতে থাকে। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে তারা কর বা খাজনা আদায় করত। " বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে"- এখানে সেই খাজনার কথাই বলা হয়েছে। বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য তখন বন্ধ হওয়ার মুখে। এই মারাঠা বর্গিদের ঠেকাতেই কলকাতায়  "মারাঠা ডিচ" খনন করা হয়। তবে এতকিছু করেও বাংলা থেকে মারাঠাদের তাড়ানো যায়নি। অবশেষে আলিরবর্দি খাঁ মারাঠাদের হাতে উড়িষ্যা ছেড়ে দিলে মারাঠাদের অত্যাচার থেকে নিস্তার পায় বাংলা। তবে বলা বাহুল্য তখন বাংলায় মারাঠাদের আক্রমনের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে বর্গি হানার ভয়াবহ স্মৃতি শিশুদের ঘুমপাড়ানি গানে স্থায়িভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

আমরা বড় হবার সাথে সাথেই একটা জনপ্রিয় খেলা প্রায় সকলেই খেলেছি। এখনো হয়তো বিকাল বেলায় অথবা অবসর সময় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, ভাই বোন অথবা বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে এই খেলার প্রচলন আছে। তা হল -আঙুল গুনে ‘ইকিড়-মিকিড়’ খেলা। 

“ইকিড় মিকিড় চামচিকির

চামে কাটা মজুমদার।     

ধেয়ে এল দামোদর।    

দামোদরের হাঁড়িকুড়ি      

দুয়ারে বসে চাল কুড়ি।      

চাল কুড়িতে হল বেলা   

ভাত খায়নি দুপুরবেলা।  

ভাতে পড়ল মাছি,  

কোদাল দিয়ে চাঁছি।  

কোদাল হল ভোঁতা  

খা কামারের মাথা"।

এই ছড়াটির মধ্যেও প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে  বাংলার ইতিহাসের অনালোচিত একটি পর্ব। যা ভাবলে অবাক হতে হয়। শিশুদের নির্ভেজাল আনন্দের জন্য এই ছড়ার রচনা হলেও এর সত্যটা বেশ করুণ। আদতে আনন্দের ছিঁটেফোঁটাও নেই এই ছড়ায়। এই ছড়ায় ছড়াকার অসাধারণ দক্ষতার সাথে চিরন্তন বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। ছড়াটির প্রতিটি শব্দ ও পংক্তি ধরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় - 

'ইকড়ি' অর্থ সংসার প্রতিপালনের জন্য সারাদিন খেটেখুটে কঠোর পরিশ্রম করে তাতেও যখন সংসার চলে না, তখন প্রয়োজন হয় 'মিকড়ি', অর্থাৎ আরও কিছু অতিরিক্ত উপার্জনের চেষ্টা করা। 'চাম' অর্থ রুজি-রোজগারের এলাকা। আর 'চিকড়ি' অর্থ সেই রোজগারের এলাকায় ঘুরে ঘুরে কিছু (অর্থ বা ফসল) উপার্জন করে তা ঘরে নিয়ে আসা। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এই "চামের কাঁটা মজুমদার"। 'মজুমদার' মূলত এক প্রকার রাজকর্মচারীর পদবী যার কাজ ছিল খাজনা বা রাজস্ব আদায় ও হিসেব রাখা। আর তাই অনেক সময় খাজনা আদায়ের নামে দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যেত বলে তাকে পথের কাঁটা বলা হয়েছে।

"ধেয়ে এল দামোদর"। এই 'দামোদর' হলো মূলত ফড়ে-পাইকারের দল, যাঁরা সাধারণ কৃষকের উৎপাদিত ফসল অথবা কুমারের বানানো তৈজসপত্র স্বল্প দামে কিনে নিয়ে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করতো। কিন্তু এই দামোদর শুধু এসেই ক্ষান্ত হয় না। এখানে বলা হয়েছে "দামোদরের হাঁড়ি-কুঁড়ি"। এর অর্থ হলো, তারা যখন আসে তখন সাথে করে হাঁড়ি কুঁড়ি নিয়ে আসে। অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষের উৎপাদিত সব দ্রব্য সাথে করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।  "দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি", অর্থাৎ মজুমদার আর ফড়ে পাইকারের থেকে লুকিয়ে যেটুকু চাল বাঁচানো গিয়েছে, এবার সেটা দিয়েই ঘরের দরজায় বসে ভাত রাঁধার প্রস্তুতি শুরু।

কিন্তু "চাল কাঁড়তে হল বেলা", অর্থাৎ এতসব ঝামেলা ঝক্কি সামলাতে গিয়ে ভাত রাঁধায় দেরী হয়ে যায়। তাই "ভাত খাওগে দুপুরবেলা", অর্থাৎ প্রথম প্রহরে বা সকালে খাওয়া আর সম্ভব হয় না। একেবারে দ্বিপ্রহরে বা দুপুরে খেতে হয়।

কিন্তু খাবে কী করে! কারণ "ভাতে পড়ল মাছি"। এখানে 'মাছি' বলতে আসলে চোরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ গরীবের যে যৎসামান্য খাদ্য, তারও শেষ রক্ষা হয় না। ছিঁচকে চোর সেটাও চুরি করে নিয়ে যায়। তাই "কোদাল দিয়ে চাঁছি"। এই 'কোদাল'ও আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং কোদাল বলতে এখানে কোতোয়াল বা পুলিশের কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের কাছে গিয়ে চোরের ব্যাপারে নালিশ করা হয়েছে।

তবে তাতেও যে গরীব মানুষের হয়রানি কম হয়, তা কিন্তু নয়। কারণ "কোদাল হল ভোঁতা"। অর্থাৎ পুলিশ বা কোতোয়াল কোন কাজই করে না। আর তাই "খা কামারের মাথা"। অর্থাৎ এই কোদাল যে কামার বানিয়েছে, মানে পুলিশ কোতোয়াল সৃষ্টিকারী গ্রামের উচ্চপর্যায়ের লোকেরা, শেষমেশ তাদের কাছে গিয়েই এই হতদরিদ্র মানুষ গুলোকে মাথা কুটে কাঁদতে হয়।

সুতরাং বলা যেতে পারে এই ছড়ায় ছড়াকার গ্রাম বাংলার সেই খেটে খাওয়া মানুষের জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন। যে কঠোর পরিশ্রম করেও জমিদার, খাজনা আদায়কারী, অসাধু ব্যবসায়ী, চোর, পুলিশ এদের উপদ্রবে নিজের পরিবারের জন্য দু' বেলার খাবারও জোটাতে পারে না।

এবার আসা যাক আরেকটি ছড়ার কোথায়-

    “আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে। 

          ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।

    বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।  

          ঢুলি গেল সেই কমলাফুলি।। 

     কমলাফুলির টিয়েটা। 

           সুয্যিমামার বিয়েটা।। 

      আয় রঙ্গ হাটে যাই।  

            এক খিলি পান কিনে খাই।।  

      পানের ভিতর ফোঁপড়া। 

              মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া।।

          হলুদ বনে কলুদ ফুল। 

                মামার নামে টগর ফুল।।”

‘ছেলে ভোলোনো ছড়া’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, এই ছড়াটির প্রথম কয়েকটি ছত্রে বিবাহ যাত্রার বর্ণনা রয়েছে। অভিজাত পরিবারের বিয়ের শোভাযাত্রা আগে ছিল যুদ্ধযাত্রারই পরিমার্জিত রূপ। কারণ একটা সময় পর্যন্ত জোর করে তুলে আনা বিজিত গোষ্ঠীর মেয়েদের বিয়ে করবে বিজয়ী গোষ্ঠীর ছেলে, এমনটাই ছিল প্রথা। এমনকি ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই তখনকার বিয়েতে জয়ঢাকও বাজানো হত। এই ছড়াটিতে তেমনই একটি বিবাহযাত্রার কথা বলা হয়েছে। তবে মূল ছড়ার প্রথম অংশটি আসলে ‘ডোম চতুরঙ্গের’ বর্ণনা।

সাতগাঁ বা সপ্তগ্রামের বাগদি রাজা হরিবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তাঁর ছিল বাগদি আর ডোম সেনা। বাগদি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করে, আর ডোম সেনারা রাস্তা তৈরি করে, শত্রুর উপর নজর রাখে। রাজনগরের সামন্তরাজাদের এবং বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের এই ডোম সেনা ছিল। এখানে ‘আগডোম’ মানে অগ্রবর্তী ডোম সেনাদল, ‘বাগডোম’ মানে বাগ বা পার্শ্বরক্ষী ডোমসেনা আর ‘ঘোড়াডোম’ মানে অশ্বারোহী সৈন্যদল। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলেই এই ডোমসেনারা আগে গিয়ে রাস্তার অবস্থা দেখে পথ তৈরি করতেন এবং ঘোড়ায় চড়ে সমস্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেন আর সেই খবর পৌঁছে দিতেন অন্যদের। এরা হলেন রাঢ় অঞ্চলের সেই সমস্ত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যাদের নির্ভীক আত্মবলিদানের জোরেই সমাজের ওপর তলার রাজা-মহারাজারা যুদ্ধ জয় করতে পারতেন। আমাদের তথাকথিত ইতিহাসে ভুরিভুরি যুদ্ধবিগ্রহ, রাজারাজড়ার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, ডোমসেনাদের মতো মাঠে নেমে যুদ্ধ জেতানোর কারিগরদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি সেখানে। বরং তাদের বীরগতির কথা, যুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতির কথা ধরা আছে এরকম সব খেলার ছড়ায়, প্রবাদে, বাংলার লোকসঙ্গীতে আর লোকগাথায়। তবে ছড়াগুলি গড়ে ওঠার কোনও লিখিত ইতিহাস যেহেতু নেই, তাই বিশ্লেষণগুলি নিয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে। কিন্তু এগুলির ঐতিহাসিক ভিত্তি এবং মূল্য কোনটাই ফেলনা নয়।

নকশি কাঁথা আলপনার মত ছেলে ভোলানো ছড়াও প্রধানত মেয়েদের তৈরি। কখনো কখনো ছোট শিশুদের খেলার অঙ্গ হিসাবেও এই সমস্ত ছড়াগুলো রচনা হয়েছে। সেই রকমই একটা জনপ্রিয় ছড়া " এলাটিং, বেলাটিং সই লো, কিসের খবর আইলো"। এই খেলাটি একটি কথোপকথনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

     প্রথম পক্ষঃ এলাটিং বেলাটিং সইলো।

    দ্বিতীয় পক্ষঃ কীসের খবর আইলো?

   প্রথম পক্ষঃ রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কোন বালিকা চাইল?

প্রথম পক্ষঃ অমুক বালিকা চাইল।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কী প’রে যাবে?

প্রথম পক্ষঃ বেনারসী প’রে যাবে।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কীসে ক’রে যাবে?

প্রথম পক্ষঃ পালকি ক’রে যাবে।

দ্বিতীয় পক্ষঃ কত টাকা দেবে?

প্রথম পক্ষঃ হাজার টাকা দেবে।

দ্বিতীয় পক্ষঃ নিয়ে যাও নিয়ে যাও বালিকা। 

এর অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে পারলে আমাদের গা শিউরে ওঠে। তখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থের বিনিময়ে মেয়ে কেনাবেচা চলত। রাজা বা জমিদাররা অর্থের বিনিময়ে নিজেদের ভোগের জন্য গরিব ঘরের মেয়েদের কিনতেন। এই খেলাটির মধ্যে সমাজ ব্যবস্থার এক করুন এবং নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে।

এরকম অনেক ছড়ার খেলা শৈশবে আমরা খেলেছি, এখনো গ্রামাঞ্চলে গ্রীষ্মের দুপুরে অথবা ঝড় বৃষ্টির দিনে বাড়ির বাইরে না যেতে পারার জন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলে আনন্দ পায়। কিন্তু শিশু মন বুঝতে পারে না এই সমস্ত ছড়ার অন্তর্নিহিত অর্থ কী? আমরা বড়রাও হয়তো অনেকে এই সমস্ত লৌকিক ছড়ার অর্থ অনুধাবন করি না। তাই বলা যেতেই পারে এভাবেই সময়ের চালচিত্র হয়ে আমাদের সমাজজীবনের জীবন্ত দলিল বহন করে চলেছে এই ছড়াগুলি। বাঙালির ছড়া সংগ্রহের কথা বলতে গেলে সবার আগে যার নাম করতে হয় তিনি হলেন বাংলা ছড়ার প্রথম সংগ্রাহক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জমিদারির সুবিধা থাকায় বহু অঞ্চল থেকে তিনি নিজে যেমন ছড়া সংগ্রহের কাজ চালিয়েছেন, তেমনি অন্যদের দিয়েও সংগ্রহ করিয়েছেন এবং তাঁর বহু রচনাতেই এই ছড়াগুলির প্রভাব ও অনুপ্রেরনা আমরা দেখতে পাই। এছাড়াও, বাংলা ছড়ার আলোচকদের মধ্যে আছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রমুখরা।

শৈশব মানে চিন্তাহীন নির্ভার একসময়- আজ আধুনিকতার এই যুগে শিশুদের শৈশব বলে কিছু নেই। ভালো রেজাল্ট আর শিক্ষিত হবার তকমা নিয়ে এখনকার শিশুরা ছুটে চলেছে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে। জন্ম থেকেই তার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারি ভারি বইয়ের বোঝা। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ,কম্পিউটার। অভিভাবকের রক্ত চক্ষুর রাঙানিতে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে শৈশবের শৈশবত্য। 

এখনকার শিশুরা ভুলে যেতে বসেছে আমাদের গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে এমন অজস্র ছড়া লুকিয়ে আছে। ইতিহাস শুধু রাজা রানীর কথা বলে, কিন্তু এই ছড়াগুলো হারিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে ইতিহাস। তাই এখন আমাদের কর্তব্য এগুলি সংরক্ষণ করা এবং পরের প্রজন্মে এগুলি সঞ্চারিত করে দেওয়া, যাতে তারাও তাদের শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে ও জানতে পারে বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারের মণিমাণিক্যের কথা।

Comments

Popular posts from this blog

মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সফলতা

কলকাতা হাইকোটের নির্দেশ অনুযায়ী ....