ভালবাসা দিয়ে জয় করো
স্বামীস্মরণানন্দ
প্রশ্ন হলো আমরা ভালবাসা দিয়ে জয় করব কীভাবে? 'জয় করা' এই শব্দটি সাধারণত মনের মধ্যে সৈন্যবাহিনী, যুদ্ধ, অধিনতা এই ভাবগুলির সৃষ্টি করে। এগুলিই হলো জয় করার সাধারণ অর্থ। কিন্তু ভালবাসা দিয়ে জয় করার সঙ্গে যুদ্ধ, ঘৃণা বা শত্রুতার কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, প্রকৃত ভালবাসায় একজন অপরজনের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করে। ভালবাসার পাত্রের সঙ্গে সমত্ববুদ্ধি সমস্ত ব্যবধানে মুছে দেয়।
এমনকী ঈশ্বরকে ভালবাসার দ্বারা পাওয়া যায়। ভগবান শ্রীমদ্ভাগবতে বলেছেন — "অহং ভক্তাপরাধীনো হ্যস্বতন্ত্র ইব দ্বিজ।" — অর্থাৎ, আমি আমার ভক্তদের অধীন, আমার সব স্বাধীনতা সেখানে হারিয়ে যায়। একটি সুফি গল্পে বর্ণিত হয়েছে একজন প্রেমিক তার দয়িতার বাড়ি গিয়ে দরজায় করাঘাত করলেন। ভিতর থেকে প্রশ্ন ভেসে এল —'তুমি কে?' প্রেমিক তাঁর পরিচয় দিলেন, কিন্তু দরজা খুলল না। আবার সেই একই প্রশ্ন ভেসে এল। প্রেমিক উত্তর দিলেন — 'আমি তোমার নিজের ।' এবারও দরজা খুলল না। তৃতীয়বারও সেই একই প্রশ্ন ভেসে এল। এবার প্রেমিক উত্তর দিলেন — 'আমিই তুমি।' দরজা খুলে গেল।শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন — আমরা যদি ঈশ্বরের দিকে এক-পা এগিয়ে যাই তিনি দশ-পা এগিয়ে আসবেন। হৃদয়ই হৃদয়ের অবেদন বুঝতে পারে। ভালবাসলে প্রতিদানে ভালবাসা পাওয়া যায় — কারণ, ভালবাসা হৃদয়কে স্পর্শ করে। এক অর্থে জগতের সকলেই ভালবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত। তারা ভালবাসা পেতে চায়। তারা ভালবাসতে এবং ভালবাসা পেতে চায়। এটি কেন হয়? অদ্বৈত বেদান্ত বলে — একই আত্মা, একই ঈশ্বর সকলের হৃদয়ে অবস্থান করে। ভাগবৎ পুরাণে ভগবান বলেছেন —'অহং সর্বেষু ভূতেষু ভূতাত্মাঽবস্থিতঃ সদা' — আমি আত্মারূপে সকলের হৃদয়েই অবস্থান করি। ভালবাসা আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলকে স্পর্শ করে। ভালবাসা মানে ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণ নয়। নারদ বলেছেন — 'আমাদের সমস্ত ধর্ম-কর্ম ভগবানের চরণে সমর্পণ করা এবং কখনো মুহূর্তকালের জন্যও তাঁকে বিস্মৃত হলে অন্তরে যদি তীব্র ব্যাকুলতা দেখা যায় তাই-ই ভক্তি '।বৃন্দাবনে গোপীদের এই ধরনের ভক্তিলাভই হয়েছিল। এই ভালবাসা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থপর, কেবলমাত্র ভালবাসার পাত্রের সুখ চায়।প্রকৃত প্রেম প্রতিদান চায় না। এটি হলে নেতিবাচক যা কিছু — হিংসা, দ্বেষ, ক্রোধ সব চলে যায়। ভালবাসা দিয়ে জয় করলে জয়ীর প্রতি বিজিতের কোনো হিংসা দ্বেষ থাকে না কারণ, ভালবাসার প্রকৃতিই হল মধুর। ভালবাসার দ্বারা ব্যক্তির বিকাশ ঘটে।এটি সত্য যে, ভালবাসা — চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে — সেই ভাবেই মানুষকে আকর্ষণ করে। রামকৃষ্ণ - ভাবান্দোলনের প্রথম যুগে যখন শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ সন্তানরা জীবিত ছিলেন তখন যুবকেরা কেবলমাত্র তাঁদের সর্বব্যাপী ভালবাসার টানেই তাঁদের কাছে যেতেন।এই ধরনের পরাভক্তি বা উচ্চতম প্রেম পৃথিবীতে একান্ত বিরল। যাঁরা ঈশ্বরীয় ভাবের গভীরে নিমজ্জিত তাঁরাই এটির অধিকারী কারণ এই অবস্থাতেই একমাত্র সর্বত্র একই সত্তার প্রকাশ অনুভূত হয়। আমাদের যারা শত্রু বা ঘৃণা করে তাদের ভালবাসা প্রকৃতই দুরূহ। কিন্তু সমস্ত আধ্যাত্মিক - তত্ত্ব শিক্ষা দেয় যে, যদি সমস্ত অস্তিত্বের উৎস সেই দৈবী-শিখা যা প্রত্যেকের হৃদয়ে বিদ্যমান, তাকে অনুভূতি-লাভ করতে হলে এটি আমাদের শিখতেই হবে।আজকের জগতে এই নিঃস্বার্থপর ভালবাসার প্রয়োজন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন — "জগতের ধর্মগুলি প্রাণহীন মিথ্যা অভিনয়ে পর্যবসিত। জগতের এখন একান্ত প্রয়োজন হলো —চরিত্র। জগৎ এখন তাঁদের চায়, যাঁদের জীবন প্রেমদীপ্ত ও স্বার্থশূন্য।" জগতের শ্রেষ্ঠ আচার্যগণ — শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, যিশু, রামকৃষ্ণ — সকলেই এই প্রেমের সাধনা করেছেন ও তা প্রচার করেছেন। তাঁদের কাছে এই প্রেম সহজাত ও স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা। সাধারণ জীবকে এই ভক্তি লাভ করতে লে কঠোর সাধনা ও প্রার্থনা করতে হবে। এজন্য আমাদের জ্ঞানদৃষ্টি-র দরকার। আচার্য শঙ্কর বলেছেন — ' দৃষ্টি জ্ঞানময়ীং কৃত্বা পশ্যেদ্ ব্রহ্মময়ং জগৎ' — অর্থাৎ, জ্ঞানের দ্বারা দৃষ্টিকে শুদ্ধ করে জগৎকে ব্রহ্মময়রূপে দর্শন করো ।তাহলেই সমস্ত জগৎকে জয় করা সম্ভব ।ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তত আমাদের কিছু করা দরকার । 'সল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ' — এই ধর্মের (নিষ্কাম কর্মযোগের) অতি অল্পমাত্রও মহাভয় হইতে রক্ষা করে (শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা, ২ /৪০)।
---- ধন্যবাদান্তে প্রতিনিধি বেবি চক্রবর্ত্তী-আড়ালে আবডালে নিউজ।
Comments
Post a Comment