" পথের দৈর্ঘ্য কম হলে জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়ে" -

পার্থ মুখোপাধ্যায়: শীতের সকাল - ধুতি আর শত ছিন্ন জামা পরিহিত এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা রাস্তার ধারে ক্লান্ত হয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সেই রিকশাওয়ালার ধুলো মাখা পায়ের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। ধুলো মাখা রক্তাক্ত পায়ের অজস্র পদচিহ্ন আঁকা হয়ে রয়েছে ওই রাস্তার ওপর। একটু বিশ্রাম নিয়ে হাতে টানা ঐ রিকশাটাকে সঙ্গী করে সে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। 

চিতপুর রোড এর উপর এক জুতোর দোকানে বসেছলেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। সামনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কত মানুষ। সেই সমস্ত মানুষের মাঝে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন ওই ভদ্রলোক। নিত্ত্বনৈমিত্তিক এই সাধারণ ঘটনা দেখেই ওই ভদ্রলোকের মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে গেল। 

তখন পরাধীন ভারতবর্ষ। জুতো কেনার মত সামর্থ্য ছিল খুব কম মানুষেরই। তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে জুতো পরার সামর্থ্য ছিল মেরেকেটে মাত্র এক কোটির মত। কারণ তখন জুতো জাপান থেকে আমদানি করতে হতো। সেই জন্য সবার পক্ষে জুতো পরা সম্ভব  হয়ে উঠতোনা। তাই বেশিরভাগ মানুষই খালি পায় যাতায়াত করতেন। 

কয়েকদিন পর হাওড়া ব্রিজের এক কোণে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছেন সেই মাঝবয়সি সাহেব। সেদিনের সকালের ওই ঘটনা সাহেবের মনে উথাল পাথাল করছে। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সব মানুষের পায়ের দিকে চেয়ে রয়েছেন আর পকেট থেকে একটা নোট বই বার করে কি যেন আঁকিবুকি কাটছেন। সেই নোটবইয়ের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ভদ্রলোকের নাম টমাস বাটা। টমাস সাহেবের মাথায় এল ভারতের বুকে প্রথম বাটার জুতো তৈরির কারখানা করার পরিকল্পনা। এর কিছু দিনের মধ্যেই তিনি খোঁজ পেলেন গঙ্গার তীরে কোন্নগর গ্রামে রয়েছে এক পরিত্যক্ত তেল কল। কলকাতার এন্ডারসন রাইট কোম্পানি এই তেলকল চালালেও গ্রেট ডিপ্রেশনের ধকল সইতে না পেরে প্রায় বছর তিনেক ধরে তা বন্ধ আছে। এই তেল কলের জায়গায় ছিল দিনেমারদের ডক আর সামুদ্রিক জাহাজ তৈরির কারখানা। টমাস সাহেব কোন্নগরের এই কারখানাকে পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নিলেন। কলকাতা থেকে গুদামঘর এবং অফিস সহ সবকিছুই কোন্নগরে নিয়ে আসা হলো। এর সাথে এলেন ১৪ জনের তরুণ চেক সাহেবের একটা টিম। 

অত্যধিক উৎসাহে কর্মীরা কারখানা চত্বরের সমস্ত ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার করে ভলিবল কোর্ট বানিয়ে ফেললেন। আবার এর পাশাপাশি একটা সুইমিংপুলও খুঁড়ে ফেললেন তাঁরা। কারখানার গেটের ওপর ঝুলল বাটার সাইনবোর্ড। গঙ্গা তীরে বসলো লোহার জেটি। আর কারখানার মাঝখানে ঘন্টা বাজানোর জন্য বড় বড় দুটো লোহার পাত বসানো হলো। 

 ১৯২৫ সাল থেকে শুরু করে ছয় বছর ধরে বাটার জুতা আমদানি করা হতো চেকোস্লাভাকিয়া থেকে। জুতো আমদানি করার পর টমাস সাহেব বুঝতে পারলেন যে দেশে সাধারণ মানুষের দৈনিক আয় মাত্র কয়েক আনা সেই দেশের মানুষ কেমন করে জুতো কিনবে!  অনেক ভাবনা চিন্তার পর টমাস সাহেব একটা উপায় বার করলেন। তিনি ভাবলেন এই দেশের মানুষের পায়ে জুতো পরাতে গেলে বিদেশ থেকে জুতো আমদানি করলে চলবে না। এই দেশে বসেই, এই দেশের চামড়া দিয়ে এই দেশের শ্রমিকদের হাতেই তৈরি করা হবে বাটার জুতো। তবেই এই দেশের সাধারণ মানুষরা আমদানি শুল্কো ছাড়া কম দামে জুতো কিনতে পারবে। এই ভাবনাকে মাথায় রেখে কোন্নগরের বুকে তৈরি হলো জুতো কারখানা। কিন্তু এই কারখানা তৈরির জন্য সামনের পথ ছিল বড়ই অমসৃণ। কোন্নগরে এসে তারা বাংলা তো দূরের কথা ইংরাজিও ঠিক করে বলতে পারতেন না। ফলে নতুন কর্ম নিয়োগ করা থেকে শুরু করে বাজার করা, খাবার তৈরি করা সবকিছুতেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষা। আর দ্বিতীয় সমস্যাটা ছিল অদ্ভুত রকম। তখন হাওয়াইচটি পড়ার চল তেমন ছিল না। তাই ভারতবর্ষের গরম আবহাওয়ার কথা ভেবে বাটা কোম্পানির প্রথম আমদানি শুরু করে সাদা হাওয়াই চটি। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী সাদা রং মানুষের কাছে শোকবার্তা বহন করে আনে তাই সাদা রং-এর চটি মানুষ কিনতে অস্বীকার করে। ফলে বড়সড়ো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হল জুতো কারখানার। আর এই আর্থিক ক্ষতি নিয়েই যাত্রা শুরু করলো বাটার জুতো তৈরির কারখানা। 

সালটা ১৯৩২-কোন্নগরেই সেলসম্যানদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুরু হলো। ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো বাটাক্লাব। বহু স্থানীয় মানুষদের বিনামূল্যে বাটার জুতো বিতরণ করে বলা হলো সেই জুতো পড়ে কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় গিয়ে হাঁটার জন্য। ফলে সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে বাটার জুতো চিনতে শিখল। মাত্র এক বছরের মধ্যেই এদেশে ৮৬ টা শহরে রিটেল চেন বিস্তার করে ফেলল বাটা। কোন্নগরের বুকে ও তৈরি হলো রিটেল আউটলেট। এতকিছু করার পরেও তখনো ভারতবর্ষের মাটিতে চামড়ার জুতো উৎপাদন করতে পারিনি বাটা।

১২ ই জুলাই ১৯৩২ সুইজারল্যান্ডে কোম্পানির একটি শাখা উদ্বোধন করতে গিয়ে এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় পরলোক গমন করলেন টমাস বাটা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে ৭২ টা দেশে বাটার জুতো তৈরীর কোম্পানি আছে তাদের হেডকোয়াটার্স সেই সুইজারল্যান্ডেই। 

টমাস সাহেবের মৃত্যুর পর আকস্মিকভাবে কয়েক দিনের জন্য বাটার কাজ থমকে গেল। কিন্তু টমাস সাহেবের পুত্র জুনিয়র থমাস. জে. বাটা দায়িত্ব নেবার পর নতুন উদ্যমে কাজে এগিয়ে গেলেন। ঠিক করলেন কোন্নগরের কারখানায় তৈরি হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ চামড়ার ওয়ার্কশপ। এই ওয়ার্কশপে প্রতি সপ্তাহে ৪০ হাজার অব্দি চামড়ার জুতো তৈরি করা যাবে। 

সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে জলিন শহরের বন্দর থেকে সমস্ত যন্ত্রপাতি আর কুড়িজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিল 'মোরভা' নামে একটি জাহাজ। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা বন্দরে সেই জাহাজ এসে পৌছলো। কোন্নগরে নিয়ে আসা হলো সবকিছু। প্রয়োজনীয় কাপড়ের যোগান দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো শ্রীরামপুরের বঙ্গলক্ষী কটন মিলকে। আর কারখানার রান্নাঘরে বসেই কেমিস্টরা শুরু করলেন চামড়াকে volozcanize করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অবশেষে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে ১৯৩৩ সালের ১লা মে কোন্নগরের বুকে তৈরি হলো ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক জুতো। এই খবর টেলিগ্রামের মারফত বাটার হেডকোয়ার্টারে পৌঁছানোর সাথে সাথেই প্রবল আনন্দ আর উচ্ছাসে ফেটে পড়লো সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত বাটাকর্মীরা। 

এর ফলে ১৯৩৪ সাল থেকেই একচেটিয়া জাপানি জুতোর বাজারকে চ্যালেঞ্জ করে 'মেড ইন ইন্ডিয়া ' ট্যাগ মার্কা বাটার জুতো। জাপানি জুতো যখন তার বাজার হারাতে শুরু করলো তখন ভারতীয় ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে যারা জাপানের জুতো আমদানি করে এতদিন ব্যবসা চালিয়ে এসেছে তারাই আজ প্রভাব খাটিয়ে কোন্নগর জুড়ে বাটার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেন শুরু করল। তারা প্রথমেই রটিয়ে দিল টমাস বাটার মৃত্যুর পর বাটা কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই খবর ছাপা হল। বলা হলো বাটা আসলে স্বদেশী মুচিদের ভাত মারছে। এর ফলে বাটা কারখানার বিরুদ্ধে ছোট ছোট বিক্ষোভ হয়। এই বিক্ষোভ এক পর্যায়ে ধর্মীয় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উত্তর কোন্নগরে ব্রাহ্মণদের মধ্যে তীব্র আপত্তি দেখা দেয়। তারা বলেন, এই কারখানায় গরুর চামড়া ব্যবহার করে জুতো তৈরি করা হচ্ছে, স্থানীয় জমিদারদের প্রত্যক্ষ মদতেই বাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। 

এত আন্দোলনের পরেও বাটা কোম্পানি রমরমিয়েই চলছিল। এই কারখানায় প্রায় ১০০০ জন কর্মী কাজ করতেন তাদের মধ্যে তিনশো জনই ছিলেন কোন্নগরের বাসিন্দা। কোন্নগরের অর্থনিতীতে তার প্রভাব পড়ল। কয়েক বছরের মধ্যেই কোন্নগরের বহু পরিবার দারিদ্রতা কাটিয়ে সচ্ছল হয়ে উঠল। ব্যবসা বাড়ার সাথে সাথে স্থান সংকুলান করা দায় হলো কোন্নগরে। ওয়ার্কশপ এবং গোডাউনের জন্য জায়গা কম পড়তে শুরু করল। এরপর ১৯৩৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে সমস্ত বাটা-কর্মীদের নিয়ে কনফারেন্স হল এই কোন্নগরে। এই কনফারেন্সে ঠিক করা হলো বাটানগরে নতুন কারখানা তৈরি করা হবে। ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে বাটার যে কজন চেক সাহেব কোন্নগরে থাকতেন তারাও শেষ বারের মতো কোন্নগর থেকে বিদায় নিলেন।

আর যে জাপানি কোম্পানি কোন্নগরের তৈরি বাটা কারখানার সঙ্গে টক্কর দিতে চেয়েছিল ১৯৪১ সালের পার্ল হারবার আক্রমণের পর জাপানি শিপমেন্ট আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জাপানি জুতো ভারতের বাজার থেকে মুছে যায়। 

চিতপুরের রাস্তায় দেখা এক বৃদ্ধ রিশকাওয়ালার পা দিয়ে রক্ত ঝড়া ধরা দেখে ভারতে জুতো কারখানা তৈরি করার স্বপ্নকে যিনি বাস্তবায়িত করেছিলেন সেই টমাস বাটার জীবনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁর জীবনীটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় মনে করেছিলেন চাকরি প্রত্যাশী প্রত্যেকটি তরুণ তরুণীর এনার জীবনী পড়া উচিত। বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ও টমাস সাহেবের জীবনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। টমাস সাহেবের একটি উক্তি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, " পথের দৈর্ঘ্য কম হলে জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়ে"। জানা যায়, টমাস সাহেব অদ্ভুতভাবেই তার তৈরি জুতোর দাম '৯' সংখ্যা দিয়ে শেষ করতেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, ১০০ জায়গায় ৯৯ লিখলে ক্রেতারা বলবেন " ১০০ টাকার ও কমে পেলাম"। টমাস বাটার সেই ট্রাডিশন আজও চলছে।

Comments

Popular posts from this blog

মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সফলতা

'দরবারী পদাবলী'-তে গুরু-শিষ্য পরম্পরার অনবদ্য নজির কলকাতায়