চাঁদের গহব্বরে আজও ভাস্বর ড: শিশির কুমার মিত্রের নাম

পার্থ মুখোপাধ্যায়: মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে যে সমস্ত বিজ্ঞানী বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক ডক্টর শিশির কুমার মিত্র। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর পরে বেতার গবেষণায় আলোড়ন তুলেছিলেন প্রচার বিমুখ এই বিজ্ঞানী। বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের মনে বেতার সংযোগ ও পদার্থবিদ্যার শিকড় গেঁথে দিয়েছিলেন তিনি। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের সূচনা হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তিনি তাঁর পরিবারের একের পর এক অকাল মৃত্যু দেখেছেন। তবু তিনি ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল। রেডিও 'টু- সি- জেড'(2CZ) কেন্দ্রের মাধ্যমে কলকাতা থেকে দেশে প্রথম রেডিও সম্প্রচার চালু করেছিলেন।

ইসরোর দ্বিতীয় চন্দ্রযাত্রা পুরোপুরি সফল হয়নি ঠিকই। কিন্তু চন্দ্রায়ন ২ এর ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদের আধার পিঠে কোথায় হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও অরবিটার কাজ করে যাচ্ছে। সেই অরবিটারের পাঠানো ছবিতে ধরা পড়েছে চাঁদের মাটিতে অজস্র গহবরের মধ্যে ৯২ কিলোমিটার চওড়া একটি গহবর আছে। যে গহবরের নাম বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ ডক্টর শিশির কুমার মিত্র নামে রাখা হয়েছে 'মিত্র ক্রেটার'। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে শিশির কুমার মিত্র আজও এক বিস্ময়। 

 ১৮৯০ সালের ২৪ শে অক্টোবর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) হুগলি জেলার কোন্নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জয়কৃষ্ণ মিত্র বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আর মাতা শরত্ কুমারী দেবী ছিলেন ভাগলপুর নগরের লেডি ডাফরিন হাসপাতালের সুচিকিৎসক। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তখন শিশির কুমার মিত্রের বয়স মাত্র সাত বছর। সেই সময় থেকেই বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার আগ্রহ তাঁর বাড়তে থাকে। পড়ার বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়তে শুরু করে ছোট্ট শিশির। জয়কৃষ্ণ মিত্রের চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। ছোট্ট শিশিরের অনুসন্ধিতসু মনে তখন থেকেই একটি প্রশ্ন তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। 

" উঠল বেলুন গড়ের মাঠে

নামলো গিয়ে বসিরহাটে..." 

এই ছড়াটা তখন লোকমুখে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। বেলুন মাটিতে না নেমে কিসের টানে কেমন করে আকাশে উঠছে? এই প্রশ্ন শিশিরের ছোট্ট মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শিশিরের বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র এক গোড়া হিন্দু পরিবারের সন্তান হবার সত্বেও তৎকালীন হিন্দু সমাজের অনেক গোঁড়ামি তিনি সহ্য করতে পারেননি। সেই জন্য ব্রাহ্মসমাজের উদার আধুনিকতায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে বিপিনচন্দ্র পাল, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমূখ মনীষীর সাথে বন্ধুত্ব হয় শিশিরের পিতা জয়কৃষ্ণ মিত্রের। চাকরির সুবাদে শিশিরের পিতা -মাতা দুজনেই ভাগলপুর জেলায় কর্মরত থাকার জন্য ভাগলপুর জেলা স্কুলেই তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। বাড়িতে থাকা বিজ্ঞানের বই নিয়েই নিয়মিত পড়তে শুরু করেন শিশির কুমার।    শিশির কুমারের শৈশব মোটামুটি আনন্দে কাটলেও সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। পরিবারে ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা। শিশির কুমারের বড় দুই ভাই সতীশ কুমার এবং সন্তোষ কুমার মিত্র দুরারোগ্য অসুখে পরপর দুজনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তাঁদের মা নিজে চিকিৎসক হয়েও সন্তানদের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। কোন রকমে শোককে সহ্য করে নিলেও খুবই ভেঙে পড়লেন। কিন্তু পিতা জয়কৃষ্ণ এই পুত্র শোক মেনে নিতে পারলেন না। মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে এক সময় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়লেন। জয়কৃষ্ণ মিত্রের হার্ট অ্যাটাক হল। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন। ফলে পুরো সংসারের দায়ভার এসে বরতালো মায়ের উপর। প্রবল আর্থিক অনটনে শিশিরের পড়াশোনা প্রায় বন্ধের মুখে। শিশিরের পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন তাঁর মা শরত্ কুমারী দেবী। দিনরাত পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে অবশেষে এন্ট্রান্স পাশ করে ভাগলপুরের টি এন জে কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। অন্যদিকে দীর্ঘদিন রোগ শয্যায় থেকে শিশির কুমারের পিতা জয়কৃষ্ণ মিত্র পরলোক গমন করেন। এই অবস্থায় প্রচন্ড আর্থিক অনটনের মধ্যে পরতে হয় শিশির কুমারের পরিবারকে। তিনি ভাবলেন এবার পড়াশোনায় ইতি করে একটা চাকরি নিয়ে মায়ের বোঝা কিছুটা হালকা করবেন সে কথা তিনি তাঁর মাকে জানালে  তিনি শুনতে রাজি হয়নি বরং তাঁর মা শিশির কুমারকে ১৯০৮ সালে ভর্তি করিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানে ভর্তি হয়ে তিনি বেশ কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তির সাহচর্য লাভ করেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রমূখ। প্রেসিডেন্সি কলেজ শিশিরের জীবনে মনে হল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য মিলনক্ষেত্র। ধীরে ধীরে শিশির কুমার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে দেখে পদার্থবিদ্যার প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়। এই আগ্রহই ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এমএসসি তে উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করেছিল। এবার তিনি ভাবলেন একটা চাকরি যোগার করে তাঁর মাকে সাহায্য করার দরকার। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে তাঁর মাও এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছেন।

       আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তখন উদ্ভিদের বৃদ্ধি মাপার যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। আর এই বছরই জগদীশচন্দ্র বসুকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করা হয়। সরকারি গবেষক হিসাবে কাজ করার জন্য শিশির কুমারকে ডেকে পাঠান আচার্য স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। শিশির কুমার তখন আনন্দে আত্মহারা মনে করলেন এত মেঘ না চাইতেই জল- জগদীশ চন্দ্রের সাথে মহা উৎসাহে কাজ শুরু করলেন শিশির কুমার। কিন্তু বিনিময়ে কোন রকম আর্থিক সাহায্য তিনি পেলেন না। মাঝে মাঝে জগদীশ চন্দ্র নিজের টাকা থেকে কিছু টাকা দিতেন। অন্যদিকে তাঁর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে আর অবৈতনিকভাবে কাজ করা সম্ভব হলো না। কিছুদিন পর যে কলেজ থেকে তিনি এফ এ পাস করেছিলেন সেই কলেজেই পদার্থ বিজ্ঞানের লেকচারার পদে নিয়োগ পেলেন। কিছুদিন এখানে কাজ করার পর তিনি যোগ দিলেন বাঁকুড়ার খ্রিস্টান কলেজে। এই সময় তিনি মন দিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র পড়ালেও গবেষণার প্রতি তাঁর মন আকৃষ্ট হতে থাকে। কিন্তু মফস্বলের কলেজে গবেষনার কোন সুযোগ না থাকায় বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালিখি শুরু করলেন। পরে ১৯১৪ সালে বরিশালের রায় বাহাদুর হরকিশোর বিশ্বাসের মেয়ে লীলাবতী বিশ্বাসের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

আবার এই বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ১৯১৬ সালে বিজ্ঞান কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ক্লাস চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন কিছু তরুণ প্রতিভার সন্ধান করছেন। এমন সময় সেই তরুণ প্রতিভাবানের  সন্ধান পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে কাজ করার জন্য ডাক পরল শিশির কুমারের। শিশিরের বয়স তখন মাত্র ২৬। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন তিনি। এখানে এসে তিনি আরো এক চাঁদের হাটের সন্ধান পেলেন। তিনি দেখলেন মেঘনাথ সাহা, সি ভি রমন, দেবেন্দ্র মোহন বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমূখ বিধগ্ধ শিক্ষাবিদরা সবাই উপস্থিত এক ছাতার তলায়। 

তখন সি ভি রমন আলোক বিজ্ঞানের গবেষণায় ক্রমশই খ্যাতি লাভ করছেন। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অফ্ সায়েন্সের ল্যাবরটরিতে সি ভি রমনের তত্ত্বাবধানে শিশির কুমার আলোক বিজ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সালটা ১৯১৮ - ফিলোসোফিক্যাল ম্যাগাজিনে শিশির কুমার মিত্রের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলো।  পরের বছর "ইন্টারফিয়ারেন্স অ্যান্ড ডিফ্রাকশান অফ লাইট" থিসিসের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি এস সি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

এরপর শিশির কুমারকে আর পিছনের দিকে ফিরতে হয়নি। তিনি ক্রমোশ এগিয়ে গিয়ে গেছেন সামনের দিকে। তিনি সুযোগ পেলেন ইউরোপ যাবার। ১৯২০ সালে প্যারিসের সারবোন ইউনিভার্সিটিতে প্রখ্যাত অধ্যাপক চার্লস ফেবরির গ্রুপে তিনি যুক্ত হলেন। অধ্যাপক চার্লস ফেবরি বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে ওজনের উপস্থিতি আবিষ্কার করে ভুবন জোরা তাঁর খ্যাতি অর্জন করেছেন। তামার বর্ণালী নিয়ে শিশির কুমার মিত্র তাঁর গ্রুপে কাজ করলেন। এই কাজের  উপর লেখা থিসিসের জন্যই অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র ১৯২৩ সালে সারবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয়বারের জন্য ডক্টরেট উপাধি লাভ করলেন। 

এরপর তিনি মেরি কুরির রেডিয়াম ইনস্টিটিউট, প্যারিসের ন্যান্সি ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। ন্যান্সি ইউনিভার্সিটিতে রেডিও ভাল্ব নিয়ে তখন কাজ করছেন গুটন সাহেব, সেখানে তিনি যোগ দিয়ে বেতার তরঙ্গ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তিনি রেডিও ভাল্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেন। পরে তিনি ঠিক করলেন কলকাতায় ফিরে এসে রেডিও ভাল্ব নিয়ে পড়াশোনা করবেন। এ বিষয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে জানালেন ফিজিক্সের এমএস সি কোর্সে রেডিও ফিজিক্স বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। ১৯২৩ সালের ১০ই মে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ওই চিঠির উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, " প্রিয় ডক্টর শিশির, তোমার ১৮ ই এপ্রিলে চিঠি পেয়ে খুশি হলাম। তোমার কাজে সাফল্য এসেছে জেনে খুব ভালো লাগছে। তুমি লিখেছো সিলেবাসে ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি যোগ করার কথা। বিষয়টা খুবই দরকারি এবং সময়োপযোগী তাতে কোন সন্দেহ নেই। বেশি টাকা-পয়সা লাগবে না এমন করে একটা প্রস্তাব তৈরি করো। তারপর দেখি কী করা যায়। তবে নিশ্চিত থাকতে পারো বিরোধিতার অভাব হবে না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যুদ্ধ করেই এগিয়ে যাব। নভেম্বরে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম"। 

এরপর ১৯২৩ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ' খয়রা অধ্যাপক' পদে যোগ দিলেন শিশির কুমার মিত্র। তিনি নিজেই দায়িত্ব নিলেন বেতার যোগাযোগ সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান বা রেডিও ফিজিক্স বিষয়ক পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করার। ভারতবর্ষে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম হিসেবে এই বিষয়টি যুক্ত করা হলো। যদিও তিনি ছাড়া এই বিষয়ে মেঘনাথ সাহার আগ্রহ যথেষ্ট ছিল। মেঘনাথ সাহা জার্মানি থেকে ফিরে এসে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় চলে গেছেন অনেক আগেই। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শিশির কুমার মিত্র দ্রুত গড়ে তুললেন রেডিও ফিজিক্স গবেষণা কেন্দ্র। 

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশন সংক্রান্ত গবেষণায় সাফল্য পেয়ে মাইক্রোওয়েভের ট্রান্সমিটার ও রিসিভার তৈরি করে প্রদর্শন করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। কিন্তু সে সময় বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যেহেতু মাইক্রোওয়েভ কিংবা ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের যেকোনো তরঙ্গ আলোর মত সরলেখায় চলে সেহেতু তাদেরকে কোন ধরনের বক্রতলে পাঠানো সম্ভব নয়। পৃথিবী গোলাকার বলে তার বায়ুমণ্ডল ও গোলাকার ফলে বেতার তরঙ্গ কোন দিকে পাঠালে সেটা সরাসরি সোজা চলে যাবে নাকি দিক পরিবর্তন করবে সেটা বলা সম্ভব নয়। 

আবার ইংল্যান্ডের দুই বিজ্ঞানীর ধারণা ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ার বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরিতে সক্ষম। বেতার তরঙ্গ বায়ুমন্ডলের এই স্তরে আলোর মতো প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসে। তরঙ্গের শক্তি ও কম্পাঙ্কের ওপর কোথায় কত দূরে এই তরঙ্গ যাবে তা নির্ভর করে। এই মতবাদ গৃহীত হবার পর এই স্তরের নাম দেওয়া হল কেনেলি- হেভি সাইড স্তর। 

ভারতবর্ষে বেতার সম্প্রচার বিষয়ে উৎসাহিত হয়ে ১৯২৩ সালে ' ইন্ডিয়ান স্টেটস এন্ড ইস্টার্ন এজেন্সি নামে একটা প্রাইভেট কোম্পানি ট্রান্সমিটার সম্প্রচার কলকাতায় প্রথম চালু করে। শিশির কুমার মিত্র বিশ্ববিদ্যালয় নিজের পরীক্ষা করে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে সেখান থেকে সম্প্রচার শুরু করে দিলেন। এই সম্প্রচার কেন্দ্রের নাম হল টু সি জেড (2CZ)। ১৯২৭ সালে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হবার আগে পর্যন্ত শুধু মাত্র শিশির কুমারের ট্রান্সমিটার থেকেই নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। শিশির কুমারের এই আবিষ্কার ভারতের বেতার ও পদার্থবিজ্ঞানে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। শিশির কুমার ছাড়াও আরো অনেক বিজ্ঞানী এই বিষয় গবেষণা করলেও শিশির কুমারের গ্রুপই স্তরের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হন। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার উচ্চতায় একটি নতুন প্রতিফলক স্তরের সন্ধান পান তিনি। ১৯৩৬ সালে ম্যাক্সওয়েল সোসাইটি আয়োজিত কিংস কলেজের সভায় শিশির কুমার মিত্র আমন্ত্রিত হলে তাঁর গবেষণার জন্য সেখানে স্যার এপলটন সহ আরো সব বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

ইংল্যান্ডের রেডিও ফিজিসিস্টদের সাথে আলোচনা করে শিশির কুমার মিত্র বুঝতে পারলেন রেডিও ট্রান্সমিটিং সংক্রান্ত গবেষণা শুধুমাত্র কলকাতায় বসে করা সম্ভব নয়। দেশের আরও জায়গা থেকে গবেষণা করতে হবে। ১৯৩৮ সালে মেঘনাথ সাহা কলকাতায় ফিরে এলে তাঁদের চেষ্টা আরো জোরদার হল। ১৯৪২ সালে অবশেষে প্রতিষ্ঠা হল সেই বোর্ড। শিশির কুমার মিত্র সেই বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এরপর এই বোর্ডের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মেঘনাথ সাহা। কলকাতার বাইরে হরিণঘাটায় ভারতে প্রথম আয়োনোস্ফিয়ার ফিল্ড স্টেশন নামে এক গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেন অধ্যাপক ডক্টর শিশির কুমার মিত্র।

অধ্যাপক মিত্র গবেষণাকে কখনো শুধুমাত্র গবেষণাগারে সীমিত রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না। নিজেই পরীক্ষাগারে সম্পূর্ণ দেশীয় যন্ত্রাংশ দিয়ে মাইক্রোফোন, লাউড স্পিকার তৈরি করেছিলেন। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প কারখানার ব্যাপক প্রসারের স্বপ্ন দেখেন শিশির কুমার মিত্র। বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞান সংগঠনেও প্রচুর সময় দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে তার নেতৃত্বেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা রেডিও ফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫১- ৫২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন শিশির কুমার। 

এটমোস্ফেরিক ফিজিক্সের জগতে শিশির কুমার মিত্রের যে অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় তা হল তাঁর রচিত বই 'দি অপার এটমোস্ফিয়ার। এর আগে বায়ুমণ্ডল সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত বই প্রকাশ হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত সরকার রুশ ভাষায় বইটি অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। 

অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্রের ব্যক্তিগত জীবন খুবই কষ্টে কেটেছে। জন্মের কিছুদিন পরেই তাদের প্রথম সন্তান মারা যায়। পরে তাদের আরও দুটো ছেলে হয়। ১৯৩৯ সালে তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি একা হয়ে পড়েন। 

গবেষণা ও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ডক্টর শিশির কুমার মিত্র অর্জন করেছেন বহু পুরস্কার। ১৯৩৫ সালে তিনি পেয়েছেন কিং জর্জ সিলভার জুবিলি মেডেল, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের জয়কৃষ্ণ মুখার্জি গল্ড মেডেল, ১৯৫৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সায়েন্স কংগ্রেস মেডেল, ১৯৫৮ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার দেবোপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক দেয়া হয় তাঁকে ১৯৬১ সালে। ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ও পদ্মভূষণ উপাধি পান অধ্যাপক ডক্টর শিশির কুমার মিত্র। এই বছরেই ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ করেন। 

১৯৬১ সালে দুর্ঘটনায় তাঁর বড় ছেলের মৃত্যুর পর ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিলেন শিশির কুমার। যদিও ১৯৫৩ সাল থেকেই তাঁর হৃদরোগ ধরা পড়ে।

১৯৬৩ সালের ১৩ই আগস্ট এই মহান শিক্ষাবিদ, প্রখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডক্টর শিশির কুমার মিত্রের জীবন অবসান ঘটে। 

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে চাঁদের মাটিতে নানারকম গহব্বর সৃষ্টি হয়। এদের বলা হয় 'Impact crater। চাঁদের পৃষ্ঠে এইরকম গহবর গুলির নামকরণ হয় বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নামে। যেমন জার্মানির আর্নল্ড সামার ফ্রেন্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্যানিয়েল কার্কউড, স্কটল্যান্ড এর জন জ্যাকসন, কানাডার জন প্লাসকেট। মহাকাশে ভারতের একের পর এক সাফল্যের সুবাদে সারাভাই বিক্রমের নাম এখন বহু চর্চিত। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের নাম আগেও স্থান পেয়েছে চাঁদের মাটিতে। চন্দ্রযান ২ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ভারতের অন্যতম বিজ্ঞানী বেতার- পদার্থবিদ শিশির কুমার মিত্রকে। চাঁদের উত্তরাংশে ৯২ কিলোমিটার ব্যাসের যে গহব্বর অবস্থিত সেটি প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, বেতার পদার্থবিদ, কোন্নগরের গর্ব, অধ্যাপক ডক্টর শিশির কুমার মিত্রের নাম অনুসারে 'Mitra Crater' রাখা হয়েছে।  চন্দ্রযান ২ এই গহব্বরের ছবি তুলেছিল, পরবর্তীকালে যা ইসরো প্রকাশ করে। 

শুধু চাঁদের মাটিতেই নয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডক্টর শিশির কুমার মিত্রের নাম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে প্রথম সারিতেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

Comments

Popular posts from this blog

মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সফলতা

কলকাতা হাইকোটের নির্দেশ অনুযায়ী ....