মর্গারেটের অজানা কাহিনী:-
বেবি চক্রবর্ত্তীঃ মার্গারেট ভারতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন ভাই রিচমন্ড লিখছেন ----- মার্গারেটর প্রথম ভরতযাত্রার দিনটি আমার মনে পড়ে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া জাহাজে সে যাবে। আমরা বিদায় দিতে গিয়েছি টিলবেরি ডাকে। আমার অন্য বোন ও মা-ও ছিলেন। আমার দুজন বন্ধু ছিল। এরিনজার কুক তিনি মরিসের বন্ধু ও ড্রয়ইং শিক্ষক ও অক্টোভিয়াস বান্টি । মা ও বোন কাঁদতে লাগল।
সেই কান্না পেছনে রেখে মার্গারেট ভারতে এসে পৌঁছালেন ২৪ জানুয়ারী।১৮৯৮ মাদ্রাজে। কলকাতায় ২৮ জানুয়ারী। মার্গারেটকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত হলেন স্বয়ং স্বামীজি। এই অটল নির্ভর মানুষটিকে দেখে মার্গারেটর সংশয়াতুর মন সাহসে ভরে গেল। ভারতের মাটিতে তিনি পা রাখলেন পরম আত্মাবিশ্বাসে।
কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলের এক হোটেলে মার্গারেট প্রথম অবস্থান করেন। স্বামীজি তাঁর বাংলা শেখার ব্যবস্থা করলেন। মিউজিয়াম, ফোর্ট উইলিয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেন। তখনকার চৌরঙ্গীর সঙ্গে বর্তমান চৌরঙ্গীর অনেক পার্থক্য। তখন ওই অঞ্চল জনবিরল, পরিষ্কার, সুসজ্জিত ইংরেজ পল্লী। চৌরঙ্গী দেখে পৃথক কলকাতাকে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব ছিল না। মার্গারেট এসেছেন এদেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে। তাঁর উৎসাহ ইংরেজ পাড়ায় নয়, নেটিভ পাড়ায়। তাই তিনি একলাই গাড়ি করে ঐ অঞ্চলগুলি আবিষ্কার করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেন।
ওই বছরেই ৮ ফেব্রুয়ারী আরও দুজন পাশ্চাত্য মহিলা মিসেস সারা বুল ও মিস জোক্সেকিন ম্যাকলয়েড এলেন ভারত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। মঠ তখন বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। বর্তমান বেলুড় মঠের জমি কেনার পর গঙ্গাতীরে অবস্থিত পুরানো বাড়িটার কিছু সংস্কার করা হয়। মিসেস সারা বুল, ম্যাকলয়েড সঙ্গে মার্গারেট কিছুদিন এই বাড়িতে ছিলেন।
মিসেস সারা বুল ছিলেন নরওয়েবাসী বিখ্যাত বেহালা বাদক ওলি বুলের স্ত্রী। আমেরিকার বস্টন শহরে তাঁর বাড়িতে স্বামীজি আতিথ্য গ্রহণ করেন। পরে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর কাজেও সাহায্য করতেন। স্বামীজি তাঁর নাম দেন ধীরামাতা ও তাঁকে মা বলে সম্বোধন করতেন।
মিস ম্যাকলয়েড ছিলেন স্বামীজির পরম সুহৃয় । স্বামীজি তাঁর নাম রেখেছিলেন জয়া পরে বহু সময় "জো" বলে ডাকতেন। ভারতে আগমনের পর মিস ম্যাকলয়েড স্বামীজিকে জিজ্ঞেসা করেন,"স্বামীজি কিভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি ?'' তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন 'ভারতবর্ষকে ভালোবেসে।'
বেলুড়ে গঙ্গাতীরে যে জীর্ণ ক্ষদ্র বাড়িটিতে ধীরামাতা, জয়া, মার্গারেট প্রায় দুমাস অবস্থান করেন তার পরিবেশ ছিল স্বর্গীয়। অপর তীরে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির ও বৃহৎ শীর্ষ দেখা যেত। স্বামীজি প্রতিদিন সকালে পাশ্চাত্য শিষ্যগণের সঙ্গে প্রাতরাশে যোগ দিতেন। সেই মহাপুরুষের আগমনে সেই বাড়িটি যেন তীর্থে পরিণত হত।
প্রাতরাশের পর বৃক্ষতলে বহুক্ষণ ধরে স্বামীজি কথা বলতেন। তিনি তন্ময় হয়ে বলে যেতেন ভারতের কথা। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি, মতাদর্শ, ইতিহাস, উপকথা, জাতীয়তাবাদ, দৈনন্দিন জীবনের আচার অনুষ্ঠান, প্রভৃতি সুললিত কন্ঠে বলেন ও ব্যাখ্যা দেন । মার্গারেট ও তাঁর সঙ্গীনিরা স্থান -কাল-পাত্র বিস্মৃত হয়ে তম্ময় হয়ে শুনতেন। তাঁদের চোখের সামনে ভেসে উঠত ভারতমাতার প্রাচীন মহিমময় মূর্তি।
মার্গারেট অস্থির হয়ে উঠছিলেন,এক মহৎ উদ্দেশ্যে তাঁর ভারতে আগমন। ভারতের নারী জাতির শিক্ষাকার্যে আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু স্বামীজি মোটেই সে কথা তোলেন না। মার্গারেট কাজের কথা বলতে গেলে উৎসাহ দেন না প্রথমে।
শীতের কুয়াশার দিনগুলির মধ্য দিয়ে মার্গারেটের কলকাতার সঙ্গে পরিচয় ঘটল। খড়খড়ি ওঠা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান তখনকার ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার আনাচে কানাচে। পৌঁছানোর পরদিন থেকে বিবেকানন্দ একজন সন্ন্যাসী পাঠিয়ে দেন মার্গারেট কে বাংলা শেখানোর জন্য।
বিবেকানন্দ এসময় বেলুড় মঠ তৈরীর ব্যাপার নিয়ে ছুটোছুটি করছেন। হেনরিয়েটা স্কুলের জমি কিনে দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারী মাসে মিসেস সারা বুল ও মিস ম্যাকলয়েড বেলুড়ে এলেন। একদিন কথা প্রসঙ্গে স্বামীজি মার্গারেটের কলকাতায় অবস্থানের কথা জানালেন। মিস ম্যাকলয়েড তখনই তাঁকে বেলুড়ে তাঁদের কাছে রাখবার জন্য চাকর পাঠালেন। স্বামীজির ইচ্ছা ছিল নিজের মায়ের কাছে রেখে একেবারে হিন্দু করে নেবেন।
একটু একটু করে মার্গারেট পরিচিত হলেন এ দেশের সঙ্গে। বিশেষ করে আধ্যাত্মিক অনুসঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের সঙ্গে ঘটল তাঁর প্রথম পরিচয়। দিনটি ছিল ১৮৯৮ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারী শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি। মিস ম্যাকলয়েডের সঙ্গে হাওড়া থেকে নৌকা করে দক্ষিণেশ্বরে এসে পৌঁছালেন মার্গারেট।
গঙ্গার ঘাটে নামতেই চোখে পড়ল শিবমন্দিরের ওপর মূল মন্দিরের চূড়া। সেখানে খ্রিস্টান বলে ঢুকতে পারলেন না। গঙ্গার ধারে মিস্ ম্যাকলয়েডের সঙ্গে বসে রইলেন মার্গারেট। দুই বিদেশিনীকে দেখে ছোটোখাটো ভিড় জমে গেল। মার্গারেট এলেন শ্রীরামকৃষ্ণের বাসকক্ষে। সেই ঘরে ঢুকে দেখলেন দেওয়ালের ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম ক্রুশবিদ্ধ যিশুরও ছবি বাইরে উৎসুক জনতার ভিড়। একই সঙ্গে তাঁর নিজের ধর্মবোধ এবং এদেশের মানুষের মধ্যে একটা যেন সমন্বয়সূত্র খুঁজে পেলেন মার্গারেট। প্রথম দক্ষিণেশ্বর দর্শন সমস্ত অর্থেই তাঁর কাছে স্মরণীয়। তিনি বিদেশিনী, ভারতবর্ষকে না জেনে না ভালোবেসে যদি কাজ করেন তবে তা একেবারেই বিদেশি ভাবে হবে। তাই স্বামীজি ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে শিক্ষা দিয়ে মার্গারেটকে কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন। কেবল প্রাচীন ভারতকে ভালোবাসলে চলবে না। বর্তমান ভারতকেও ভালোবাসতে হবে। কারণ প্রাচীন ভারত থেকে বর্তমান ভারত ও বর্তমান ভারত থেকে আবির্ভূত হবে মহিমময় ভবিষ্যৎ ভারত। কিন্তু বর্তমান ভারতকে কি ভালোবাসা সহজ ? চারিদিকে অজ্ঞতা, অশিক্ষা, দারিদ্র, কুসংস্কার, অপরিচ্ছন্নতা, সমস্যা। তাছাড়া পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের জীবনযাত্রার এত পার্থক্য যে পাশ্চাত্য ভাবে শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য প্রভাবিত ভারতবাসীর কাছে কঠিন ছিল তো একজন বিদেশির পক্ষে তো তাই অসম্ভবই এ দেশের সেবা করা।
মার্গারেটকে এদেশীয় মানুষের সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য ১১ মার্চ স্টার থিয়েটারে আয়োজন করা হল একটি বক্তৃতার। বিষয় ---ইংল্যান্ডে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব। স্বামীজি স্বয়ং এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। তিনি মার্গারেটের পরিচয় দিয়ে বলেন, "ইংল্যান্ড আমাদের আর একটি উপহার দিয়েছেন ----মিস মার্গারেট নোবেল। এঁর কাছে আমাদের দেশের অনেক আশা। শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত ইংল্যান্ড থেকে এসে ভারতের কাজে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেখানে মার্গারেটের বক্তৃতা সকলের প্রশংসা অর্জন করে। তিনি বক্তৃতায় বলেন, সমস্ত জগতের জন্য আপনারা শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক সযত্নে রক্ষা করে আসছেন। সেজন্য এক সেবিকার আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এদেশে এসেছি আমি, ভারতের সেবা করবো ভেবে। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যের দর্শন ভাবনার তুলনামূলক আলোচনা করে মার্গারেট প্রাচ্য দর্শনের উৎকর্ষ দেখালেন। কেমন করে স্বামীজি পাশ্চাত্য চিন্তার জগতে নতুন আলোকপাত ঘটাতে পেরেছে। স্বামীজি নিজেও মার্গারেটের ভাষণে উচ্ছ্বসিত হন।
কিন্তু মার্গারেট ভাবেন বিদ্যালয় গড়ে তুলব বলে আমি এখানে এসেছি তার কি হল ?
বিবেকানন্দর ইচ্ছা অন্যরকম। মার্গারেট এখনও বিদেশিনী। আগে তার হিন্দুত্ব প্রকাশিত হোক, তখনই সে এদেশের উপযোগী শিক্ষার কথা ভাবতে পারবে। স্বামীজি তাই মার্গারেটকে সীতা -সতী-সাবিত্রির কথা বলেন। একটু একটু করে মার্গারেটের চোখে হিন্দু রমণীর আদর্শকে চিহ্নিত করতে থাকেন। এই অনুভবে অন্তরকে আলোকিত করে তুললেই নিবেদিতা প্রকৃত শিক্ষার পথ খুঁজে পাবে ন। একটা সামগ্রিক পরিবর্তন তাঁকে ভবিষ্যতের আলো দেখাবে। তখন প্রশান্ত আত্মোপলব্ধিতে হৃদয়ের অপার মহিমায় মার্গারেট সিদ্ধিতে পৌঁছে যাবেন। এই পরিশোধন ক্রিয়ায় তাঁর মনে মনে যে এখনও মোহ আর অন্ধকার আছে তা ধ্বংস হবে।
মার্গারেট মাঝে মাঝে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। পরক্ষণেই সামলে নেন নিজেকে। গুরুর অভয় বাণী কানে ভেসে আসে, "দেখ ঐ আলো, কি স্বচ্ছ, কেমন সহজ। "
Comments
Post a Comment