কেমন আছো চন্দনী গাঁয়ের 'অঞ্জনা'?
রবীন্দ্রনাথের জীবনে বাংলার নদ নদীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। জীবনের সঙ্গে নদীর প্রবাহ যেন মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতি ও মানব জীবনের মধ্যে যে সাদৃশ্য আছে তা বারবার কবি সুনিপুণভাবে তাঁর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন।
গঙ্গা,পদ্মা, নাগর, বড়াল, ইছামতি, যমুনা, অঞ্জনা ইত্যাদি নদ নদীর নাম কবির বিভিন্ন লেখায় আমরা দেখতে পাই। কবির বিশাল সাহিত্য কর্মের মধ্যে এই বিষয়ে কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদির সংখ্যা এতটাই বিস্তৃত যে এই স্বল্প পরিসরে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি কার্যকলাপ দেখাশোনার জন্য মাঝে মাঝেই বিভিন্ন নদী পথে যাত্রা করতেন। এমনই একটি নদীর নাম 'অঞ্জনা'- একসময় নদীর স্নিগ্ধ জলপ্রবাহ মায়ের মত লালন পালন করেছে নদীয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে। জলঙ্গী নদী থেকে উৎপত্তি অঞ্জনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি লিখে ছিলেন-"অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল-ধরা— এক কোণে তারি
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী".....
অঞ্জনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর এই বিখ্যাত কবিতা। এই অঞ্জনা নদীর রুপ দেখে কাজী নজরুল ইসলাম মোহিত হয়ে লিখেছিলেন " নদীর নাম অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা"... আবার এই নদীর শোভা দেখে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন, " হে অঞ্জনে, তোমাকে দেখিয়া অতিশয় প্রীত হইলাম, তোমাকে কখনোই ভুলিব না এবং তোমার বর্ণনা করিতে ত্রুটি রাখিবো না"।
এই নদীর উপর দিয়ে একসময় বয়ে গেছে কত বাংলার বাণিজ্যতরী। আর এই নদীর উপর দিয়েই কত যাত্রী পারাপার হয়েছে। এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল বাদকুল্লো শ্মশান।তাহলে এই নদীর উৎপত্তি কেমন ভাবে হয়েছিল?
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায়, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় চূর্ণী আর জলঙ্গির মাঝে জলপথ হিসাবে এই নদীটিকে তৈরি করান। ১৭৭৬ সালে রেনেল সাহেবের ' সিস্টেমেটিক সার্ভে' তে অঞ্জনার অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। বন্যার সময়ে জলঙ্গির জলস্তর মোহনার কাছে অর্থাৎ নবদ্বীপে ভাগীরথীর জলস্তরের অপেক্ষা নীচে থাকে। এর ফলে জলঙ্গির জল ভাগীরথীতে মিশতে পারে না, পিছনের দিকে ফিরে আসে। তখনই মূল নদী কোনও ঢালু অংশে নতুন করে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই ভাবেই জলঙ্গির শাখা নদী হিসেবে অঞ্জনার উৎপত্তি।
তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে যে নদীর কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখকের কবিতা, গল্প, উপন্যাসে ধরা দিয়েছে সেই স্বপ্নের অঞ্জনা আজ কেমন আছে? জানতে ইচ্ছা করে কবির কবিতায় বর্ণিত অঞ্জনা নদীর তীরে চন্দনী গাঁ কোথায় অবস্থিত? কেমন আছে এই চন্দনী গাঁ? এই গাঁয়ে অবস্থিত যে পোড়ো মন্দিরের কথা কবি বলেছেন সেই পোড়ো মন্দিরটা কি এখনো আছে? সেই কথা জানতে গেলে আমাদের যেতে হবে নদীয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে বাদকুল্লার পূর্বদিকে। এখানেই অবস্থিত কবির স্বপ্নের 'চন্দনী গাঁ' বা চন্দনদহ গ্রাম। আর এই চন্দনদহ গ্রামের কোল দিয়েই অঞ্জনা নদীর প্রবাহ পথ। যে অঞ্জনা নদী ধর্মদহ, বাদকুল্লা হয়ে ব্যাসপুরে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। এর খানিকটা দূরেই অবস্থিত সেই পোড়ো মন্দির। যে মন্দিরের বর্তমান অবস্থার কথা কবি তাঁর কবিতায় তখনই বলে গিয়েছিলেন। অবহেলায়,অনাদরে জীর্ণ ফাটল ধরা এই পোড়ো মন্দির বর্তমানে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।যত সময় এগিয়েছে সৌন্দর্যে ভরা এই অঞ্জনা ততই তার যৌবন হারিয়েছে। তাছাড়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর শহরকে বাঁচানোর জন্য জলঙ্গীর পাশে বাঁধ দিয়ে দেয়। ফলে জলঙ্গী থেকে আলাদা হয়ে পড়ে অঞ্জনা। সেই সময় থেকেই অঞ্জনার গতি হারানো শুরু হয়। সঠিক উদ্যোগের অভাবে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায় অঞ্জনা। স্থানীয় মানুষ জনের বিরূপ মনোভাবের জন্য সব মুছে যাবে, একদিন আর অঞ্জনা নামটাও থাকবে না এলাকার কিছু প্রবীন নাগরিকরা এই আশঙ্কাই করছেন।এর সংস্কারের জন্য এলাকার একশ্রেণীর মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানালে ' সুজলা নদীয়া' নামে একটি প্রকল্পের সূচনা হয়। তবে এখনো তার কোন কিনারা হয়নি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এলাকার স্থানীয় মানুষদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে এই বিষয়ে তারা মুখ খুলতে চাননি। তাই বলা যেতেই পারে প্রশাসন এবং একশ্রেণীর মানুষের চরম উদাসীনতার জন্য আজ বিলুপ্তির পথে অঞ্জনা সহ চন্দনী গাঁ। যে নদীর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের একটি অধ্যায়, সেই নদীই আজ পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে। রবি ঠাকুরের সেই অঞ্জনা আজ বিস্মৃতির মুখে।চন্দনী গাঁয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ইটের দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে কুঁড়েঘরগুলি চেয়ে থাকে, বাতাসে মিশে থাকে এক অকৃত্রিম মাদকতা। ছটো শিশুগুলির আনন্দ হুল্লরের আড়ালে উঁকি মারে শৈশব যা শহরের ব্যস্ত জীবন আর যানজট কেড়ে নিয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমশ কচুরিপানা ও শ্যাওলার পাশাপাশি ব্যবহৃত প্লাস্টিক সহ অপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিস জমতে জমতে সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে এই অঞ্জনা। এখন সেই শুকিয়ে যাওয়া নদীতে গরু বা ছাগলদের দল চড়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসন যদি এই বিষয়ে এখনো কোন রকম উদ্যোগ না নেন তাহলে রূপকথার প্রাণোচ্ছ্বল অঞ্জনা সহ চন্দনী গাঁ এইভাবেই অনাদরে, অবহেলায় বিলুপ্তির পথে চলে যাবে, থাকবে না কোন অস্তিত্ব - শুধুমাত্র কবিতার পাতাতেই থেকে যাবে লেখকের স্বপ্নের অঞ্জনা সহ চন্দনী গাঁ।
Comments
Post a Comment