ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে আজও

পার্থ মুখোপাধ্যায়ঃ প্রায় ১৭৪ বছর আগের কথা- শরতের সকালে মনোরম পরিবেশে লিভারপুল শহরের দুই প্রতিভাবান স্কটিশ ডাক্তার ডেভিড ওয়াল্ডি ( David Waldies) আর জেমন সিম্পসন (James Young Simpson) খোশমেজাজে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। কথা প্রসঙ্গে ওয়াল্ডি তাঁর বন্ধু সিম্পসনকে বললেন ক্লোরোফর্ম জিনিসটাকে ডাক্তারি কাজে মানব শরীরে ব্যবহার করা গেলে খুবই ভালো হবে। ডেভিড সাহেব জানান তিনি এই নিয়ে পরীক্ষাও করেছেন। 

এই কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে জেমন সিম্পসন নিজেই এই বিষয় একটি বিখ্যাত জার্নালে রিসার্চ পেপার পাবলিশ করলেন। এরপরই গোটা পৃথিবী জুড়ে হৈচৈ পড়ে গেল। সিম্পসন সাহেব খ্যাতির উচ্চ শিখরে পৌঁছলেন। কিন্ত তার প্রতিভাবান বন্ধু কেমিস্ট ডেভিড ওয়াল্ডি রয়ে গেলেন সামান্য এক ফুট-নোট হয়ে ইতিহাসের পাতায়। এই ঘটনার পর তিনি স্বদেশবাসীর উপর রাগে, দুঃখে, অভিমানে ভাগ্যানেশনের জন্য নিজের দেশ ছেড়ে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন ১৮৫৩ সালে। ভারতে এসে পাঁচ বছর কেমিস্ট হিসাবে কাজ করার পর ১৮৫৮ সালে প্রথম নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন D. Waldies & Co.Ltd। শুরু হলো ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম সালফিউরিক অ্যাসিড আর রেড লিডের উৎপাদন। তিনিই প্রথম মানবদেহের এনিস্থ্যাটিক হিসাবে ক্লোরোফর্মকে ব্যবহার করেছিলেন। 

অন্যদিকে ক্রাইপার সাহেব (William Risdon Criper) বার্মার জঙ্গলে জঙ্গলে রুপো আর তামা খুঁজে ফিরছেন। এই ক্রাইপার সাহেব ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র এবং রসায়নবিদ। তিনি ইংল্যান্ডের ডেভন শহরে ১৮৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই কেমিস্ট্রি আর মেটালার্জি সহ একাধিক বিষয়ে পাঠ সম্পন্ন করে বার্মায় চাকরি জীবন শুরু করেন। তিনিও এর পরবর্তী কালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন। কর্মজীবনে তিনি একাধিক জায়গায় কেমিস্ট হিসাবে কাজ করার পর ১৮৮৫ সালে পার্টনার হিসাবে যোগদান করলেন ওয়াল্ডি  সাহেবের কারখানায়। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ডেভিড ওয়াল্ডির মৃত্যু হলে ক্রাইপার সাহেব নিজের উদ্যোগেই বরানগর থেকে কারখানাকে সরিয়ে আনলেন গঙ্গার তীরবর্তী এই ছোট্ট গ্রাম কোন্নগরে।

এই কোন্নগর গ্রামকে ক্রাইপার সাহেব ক্রমশ ভালবাসতে শুরু করলেন। তিনি এই ছোট্ট গ্রামকে এতটাই ভালোবেসে ছিলেন যে তিনি ১৯০৪ সালে গঙ্গার তীরে প্রায় ১১বিঘা জমি লিজে নিয়ে তৈরি করলেন সুবিশাল এক প্রাসাদ। 
নাম দিলেন 'কোন্নগর হাউস'। এই কোন্নগর হাউসই পরিণত হল 'লালকুঠি' বা 'সাহেব কুঠি' নামে। অবিভক্ত বাংলায় লালকুঠির মতন বিলাস বহুল প্রাসাদ ছিল খুবই কম।

কি ছিল না এই প্রাসাদে? বিলিয়ার্ড রুম থেকে শুরু করে সুবিশাল লাইব্রেরী, টেনিস কোর্ট থেকে ক্রিকেট খেলার লোন, কনফারেন্স রুম থেকে ব্যক্তিগত জেটি, এমনকি রোলস রয়েলস গাড়িও ছিল এই প্রাসাদে। প্রায় দু হাজার বছরের পুরনো বার্মার এক বৌদ্ধ স্তুপ থেকে নিয়ে আসা লাল স্যান্ডস্টোনের ভাস্কর্যকে এই স্থাপত্যে ব্যবহার করা হয়েছিল। 

অকৃতদার ক্রাইপার সাহেবের বয়স বাড়লে তার ব্যবসায় সাহায্য করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে তার ভাগ্না এরিককে ডেকে নিলেন। ১৯০৪ সালে ক্রাইপার সাহেবের ভাগ্না এরিক হেওয়ার্ড কোন্নগরের মাটিতে পা রাখলেন।

এর দু বছরের মধ্যেই এরিক সাহেব ওয়াল্ডির ফ্যাক্টরির কমপাউন্ডের মধ্যেই গড়ে তুললেন বিখ্যাত Bengal Distilleries Co Ltd। এরিকের পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তায় বাংলা ছাড়িয়ে লন্ডন, শেফিল্ড,ম্যানচেস্টার আর নিউইয়র্ক পর্যন্ত পৌঁছে গেল ছোট্ট গ্রাম কোন্নগরের ওয়াল্ডি ফ্যাক্টরির রেড লিড (Red Lead) সহ বিভিন্ন কাঁচামাল। আবার অন্যদিকে এরিকের  নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে তোলা হেওয়ার্ডস মদের খ্যাতিও দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। ভাগ্নার এই কর্মকান্ড দেখে ক্রাইপার সাহেব পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাগ্নাকে পার্টনার করে নিলেন।

স্বাধীনতার পূর্বে কোন্নগরের হেওয়ার্ডস ব্রান্ডের জিন, রাম, হুইস্কি আর ব্র‍্যান্ডির খ্যাতি লন্ডনের ড্রয়িংরুম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এর ফলে মদের ব্যবসা যেমন বাড়লো তেমনি বেড়ে চলল ওয়াল্ডি ফ্যাক্টরির তৈরি বিভিন্ন কেমিক্যাল। 

বৈভবের চূড়ায় থাকতে থাকতেই অকৃতদার, পরোপকারী, মহান ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম রিসডন ক্রাইপার ১৯৩৯ সালে ৮৪ বছর বয়সে না ফেরার দেশে যাত্রা করেন। 

তাঁর মৃত্যুর পরেও এই সাহেব কুঠিতেই ম্যানেজারদের বসবাস অব্যাহত ছিল। কিন্তু বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বা অন্যান্য কাজকর্ম দেখার মত তেমন কোন লোক ছিল না। যেহেতু ডিওয়াল্ডি কোম্পানির কর্মচারীরা ওই বাড়ি ব্যবহার করতেন সেইহেতু কোম্পানি ওই বাড়ি ব্যবহারের জন্য ২০০ টাকা ভাড়া দিতেন। গঙ্গাতীরের এই বাড়িতে বারবার মালিকানা পরিবর্তন হয়। এরপর এই বাড়িটির ভাগ্য নির্ধারিত হলো ভাগ্যকুলের জমিদার পুলিন কৃষ্ণ রায়ের হাতে। ভাগ্যকুল জমিদারী এবং কলকাতার অনেকগুলি ব্যবসার মালিক ছিলেন। 

অনেক সম্পত্তির মালিক পুলিন কৃষ্ণ রায় ১৯৪০ সাল নাগাদ বাড়িটি কিনে নেন। তখনো কিন্তু ডিওয়াল্ডি কোম্পানির বিদেশি কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবার সেখানেই বসবাস করতেন। এইভাবে অনেকবার মালিকানা হস্তান্তর হবার পর একসময় জনমানষ থেকে হারিয়ে গেল এই বাড়িটি। বন-জঙ্গল,আগাছা, বিষাক্ত সাপ ইত্যাদি প্রাণীরা বাড়িটি দখল করে নিল। ক্রমশ জরাজীর্ণ হয়ে যেতে লাগলো ইতিহাস প্রসিদ্ধ 'সাহেব কুঠি'।    

ব্রিটিশ রসায়নবিদ উইলিয়াম রিসডন ক্রাইপার দ্বারা নির্মিত কোন্নগর হাউস বা সাহেব কুঠির জন্যই যে কোন্নগরের মানুষ আজ তাঁকে মনে রেখেছে তা নয় তাঁর উদার মানসিকতার জন্য আজও কোন্নগরের মানুষ ক্রাইপার সাহেবকে মনে রেখেছে। 

তাঁর অবদানের কথা চিন্তা করলে কোন্নগরের মানুষ আজও ক্রাইপার সাহেবের পদতলে মাথা নত করে। তিনি একজন বিদেশী হয়েও বাংলায় কথা বলতে পারতেন। শোনা যায় তাঁরই উদ্যোগে এলাকাবাসীর সুবিধার জন্য নিজের টাকা খরচ করে কোন্নগরের জিটি রোড থেকে কোন্নগর স্টেশনের এক দীর্ঘ অংশকে তিনি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। 

সেই রাস্তা ক্রাইপার রোড নামে বিরজমান। যদিও পরবর্তীকালে কোন্নগর পৌরসভার পক্ষ থেকে এই রাস্তার নাম পরিবর্তন করা হলেও কোন্নগরবাসীর কাছে এই রাস্তা আজও ক্রাইপার রোড নামে পরিচিত। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাই হোক কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে তাঁর কাছে হাত পাতলেই যথাসম্ভব তিনি অর্থ সাহায্য করতেন। এছাড়া তিনি কোন্নগরের বুকে আরো কিছু নজির রেখে গেছেন। তাই আজও এখানকার মানুষের স্মৃতিতে ক্রাইপার সাহেব অমর হয়ে আছেন।

ক্রাইপার সাহেবের মৃত্যুর পর এরিকের ছেলে এন্টনি হেওয়ার্ড ব্যবসার ভার নিলেন। প্রায় এক দশক ফ্যাক্টারি চালানোর পর ১৯৫৮ সালে এই ফ্যাক্টরি Shaw Wallace কে বিক্রি করে দেওয়া হল। তারা আবার ওয়াল্ডির কারখানার মধ্যে থেকে মদের ফ্যাক্টরিকে সরিয়ে নিয়ে গেল উত্তর পাড়ার ভদ্রকালীতে। Shaw Wallace নামে এই ফ্যাক্টরি আজও চালু আছে। বর্তমানে মালিকানার হাত বদল হয়ে United Sprites এর হাতে চলে গেছে। আর সেই হেওয়ার্ডস ব্র্যান্ডের বিখ্যাত বিয়ার Haywards 5000 কে কিনে নিয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত মদ প্রস্তুতকারক সংস্থা SabMille। 

তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে ক্রাইপার সাহেবের কারখানা D.Waldies এর কী হলো? 

ইতিহাসখ্যাত এই কারখানা কোন্নগরে জিটি রোডের ধারে আজও রয়েছে। আজও রেড লেড, লেড অক্সাইড,PVC লুব্রিক্যান্ট, বিভিন্ন অ্যালার্ম এখানে তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরে একটা বিশেষ গ্লাসের প্যানেল লাগে যার একমাত্র কাঁচামাল এই ফ্যাক্টরি থেকেই সরবরাহ করা হয়। তবে বিগত ৭০ বছরের মধ্যে একাধিকবার এই কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ক্রাইপার সাহেবের প্রয়াণের পরও এই কোন্নগরের সাথে তাঁর পরিবারের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই পরিবারেরই বংশধর সাইমন হেওয়ার্ডস গোয়ায় যে হেরিটেজ হোটেল ( Vivenda dos Palhacos) খুলেছেন সেই হোটেলের সব থেকে বিলাসবহুল ঘরের নাম এই কোন্নগরের নামেই রেখেছেন। এই ঘরটা সাজানো হয়েছে কোন্নগর হাউস এবং হেওয়ার্ডস ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ইতিহাসের ছবি দিয়ে।

ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলে ভগ্নপ্রায় এক যতুগৃহ হয়ে কোন্নগরের গর্ব কোন্নগর হাউস বা লালকুঠি কবে হেরিটেজ হিসাবে ঘোষিত হবে সেই কথাই ভাবছে সময় আর ভাবছে কোন্নগরবাসী।


Comments

Popular posts from this blog

মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সফলতা

কলকাতা হাইকোটের নির্দেশ অনুযায়ী ....