স্বামী গীতানন্দজী মহারাজের জন্ম শতবর্ষের সমাপ্তি উৎসব :-

বেবি চক্রবর্ত্তী, বালিগঞ্জ, রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ স্বামী গীতানন্দ বার্থ সেন্টেনারি সোসাইটির উদ্যোগে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের  সহাধ্যক্ষ পরম পূজনীয় শ্রীমৎ স্বামী গীতানন্দজী মহারাজের জন্ম শতবর্ষ সমাপ্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কে। এই অনুষ্ঠানের সম্পাদক ছিলেন প্রফেসর ডাঃ কল্পনা সরকার এবং সভাপতি ছিলেন ডাঃ গৌড় দাস। 

স্বামী গীতানন্দজীর আধ্যাত্মিক জীবন, তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন সাথে সাথে অধ্যাত্ম সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্মৃতি চারণা করেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বিশিষ্ট সন্ন্যাসীরা ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ। এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ, কাশীপুরের অধ্যক্ষ পরম পূজনীয় শ্রীমদ স্বামী দিব্যানন্দজী মহারাজ,  রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহসম্পাদকদ্বয় পূজনীয় স্বামী বলভদ্রানন্দজী মহারাজ ও পূজনীয় স্বামী বোধসারানন্দজী মহারাজ। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের সম্পাদক স্বামী সুপর্ণানন্দজী মহারাজ, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম নরেন্দ্রপুরের  স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দজী মহারাজ, স্বামী দেবত্বানন্দজী মহারাজ, প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্রীশ্যামল কুমার সেন ও বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যক্ষ  ডাঃ সবুজ কলি সেন, প্রমুখ এদিন স্বামী গীতানন্দজী মহারাজের স্মৃতি কথা সন্মলিত পুস্তক প্রকাশিত হয়," চরণ সরোজে"।

গ্রন্থটি মহারাজ প্রকাশ করেন রামকৃষ্ণ মঠ, কাশিপুরের অধ্যক্ষ স্বামী দিব্যানন্দজী মহারাজ। এই দিন সকলে স্বামী গীতানন্দজী মহারাজের দেখ তপস্যা ও সেবার কথা আলোচনা করেন। এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ডাঃ অংশু সেন, কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক স্বামী কল্যাণেশানন্দজী মহারাজ, স্বামী অনিমেশানন্দজী মহারাজ,স্বামী শিবাধিশানন্দজী মহারাজ। এই অনুষ্ঠানে দুঃস্থ মানুষের সেবার জন্য রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের হাতে একটা কুড়ি লক্ষ টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়। যাতে দুঃস্থ মানুষ বিনামূল্যে চিকিৎসার সুবিধা পায়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু , ভক্ত এখানে উপস্থিত হয়েছিলন। তাঁদের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

রামকৃষ্ণ মঠ মিশনে সাধুদের " নাইট ক্লাস" হয়। প্রতি রাতে ওই ক্লাসে " শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ - কথামৃত" পাঠের শুরুতে পূজনীয় গীতানন্দজী মহারাজ আবেগের সঙ্গে ঠাকুরের শিখিয়ে দেওয়া এই প্রার্থনা উচ্চারণ করতেন,  এবং সব সাধুরা সমস্বরে তা আবৃত্তি করতেন। এই সমবেত প্রার্থনাতে অদ্ভুত এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হতো। মহারাজের অভিপ্রায় ছিল সকলের মনে এই দৃঢ়বিশ্বাস তৈরি করা যে শরণাগতিই ঠাকুরের কাছে পৌঁছাবার সহজতম পথ।

স্বামী গীতানন্দ মহারাজ ১৯২৪ সালের ১৭ ই এপ্রিল ঢাকা জেলায় আড়িয়াল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন যা বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত। তিনি পূর্বাশ্রমে বাসুদেব মুখোপাধ্যায় নামে পরিচিতি ছিলেন। তাঁর পিতা শ্রী দুর্গামোহন মুখোপাধ্যায় এবং মাতা সরযূবালা দেবীর ধার্মিকতা এবং পরিবারের আধ্যাত্মিক পরিবেশ বাসুদেবের অভ্যন্তরীণ জীবনকে গঠন করেছিল। তিনি তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত রামায়ণ, মহাভারত এবং শ্রীমদ্ভাগবত আলোচনা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এইভাবে অল্প বয়সেই তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

আধ্যাত্মিক পিপাসায় উদ্বুদ্ধ, বাসুদেব সেই সময়েই দৃঢ়সংকল্প করেছিলেন যে তিনি পার্থিব জীবন যাপন করবেন না। আধ্যাত্মিক আদর্শের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তিনি ১৯৪৬ সালের ১৭ ই মে , মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাইয়ের ) মাইলাপুরে রামকৃষ্ণ মঠে ব্রক্ষ্মচারীরূপে এই সংঘে যোগদান করেন এবং মাদ্রাজ মঠের তৎকালীন অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী কৈলাসানন্দজী মহারাজের ভালোবাসা ও যত্নএর অধীনে তাঁর সন্ন্যাস জীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বিশাখাপত্তনমে রামকৃষ্ণ আশ্রমে রামকৃষ্ণ সংঘের তৎকালীন ষষ্ঠ সংঘাধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী বিরজানন্দজী মহারাজের নিকট মন্ত্রদীক্ষা লাভ করেন। 


পরে তিনি ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫১ সালের ৩০ শে মে , তাঁর দীক্ষাগুরু স্বামী বিরজানন্দজী মহারাজের মহাসমাধি পর্যন্ত তিনি আট মাসের কিছু অধিক সময়ের জন্য বেলুড় মঠে তাঁকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ১৯ শে জানুয়ারি, বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের শুভ জন্মতিথি দিন, ব্রক্ষ্মচারী বাসুদেব ব্রক্ষ্মচর্যের ব্রত পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ সংঘের তৎকালীন সপ্তম সংঘাধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী শঙ্কারানন্দজী মহারাজের কাছে এবং তাঁকে ব্রক্ষ্মচারী অমেয়চৈতন্য নাম দেওয়া হয়েছিল। চার বছর পর , ১৯৫৬ সালের ১৪ ই মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথির দিন বেলুড় মঠে, তৎকালীন সপ্তম সংঘাধ্যক্ষ স্বামী শঙ্কারানন্দজী নিকট তিনি সন্ন্যাসলাভ করেন এবং তাঁর সন্ন্যাস নাম হয় স্বামী গীতানন্দ। তিনি কিছু সময়ের জন্য রামকৃষ্ণ সংঘের তৎকালীন সপ্তম সংঘাধ্যক্ষ স্বামী শঙ্কারানন্দজী মহারাজের ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭৩ এর ডিসেম্বর মাসে তিনি রামকৃষ্ণ মঠের অন্যতম ট্রাস্টি এবং রামকৃষ্ণ মিশনের পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্য ( গভর্নিং বডির সদস্য) হিসেবে নির্বাচিত হন। পরের বছর ১৯৭৪ - এর জুন মাসে মহারাজ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম সহ- সম্পাদক রূপে নিযুক্ত হন এবং বেলুড় মঠের প্রধান কার্যালয়ে  ফিরে আসেন বারাণসী থেকে। ১৯৭৫ এর এপ্রিল  মাস থেকে তিনি মঠ ও মিশনের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৫ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৮৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দশ বছর কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় বেলুড় মঠে তিনি দাতব্য চিকিৎসালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং পুনঃরায় তিনি দশ বছর ১৯৮৫ সালের ১লা এপ্রিল থেকে ১৯৯৫ সালের ১ লা এপ্রিল পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সহকারে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫  - এর  ১ লা এপ্রিল থেকে তিনি সহ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান এবং বেলুড় মঠেই থাকতে শুরু করেন। 
২০০৩ সালে স্বামী গীতানন্দজী মহারাজ, বিশ্বব্যাপী রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সহ সংঘাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। সহ- সংঘাধ্যক্ষ হিসাবে, তিনি ভারতে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন শাখা কেন্দ্র পরিদর্শন করেছিলেন এবং হাজার হাজার ভক্তদের মন্ত্র - দীক্ষা প্রদান করে তাদের কৃপা করেছিলেন। ভারতের বাইরে রাশিয়া ও মরিশাস সফর করেন। সহ - সংঘাধ্যক্ষ হওয়ার পর তিনি প্রথমে রামকৃষ্ণ মঠ বাগবাজার (মায়ের - বাড়ি)তে ২০০৩ সালের মে মাসে অবস্থান করেন। ওখানে তিনি ২৯ শে মে ২০০৫ অবধি ছিলেন। এছাড়াও তিনি জয়রামবাটিতে মাতৃমন্দিরে অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যতিথিতে ৫ই মে ২০০৩ সর্বপ্রথম ভক্তদের দীক্ষা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ৩০ শে মে তিনি কাঁকুড়গাছি রামকৃষ্ণ মঠের ( যোগোদ্যান) অধ্যক্ষের এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের ৩০ শে‌ আগষ্ট পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন। পূজ্যপাদ মহারাজের শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্রে সুপন্ডিত ছিলেন এবং তাঁর ভগবৎ পাঠ ছিল অত্যন্ত মনোগ্রাহী। এই পবিত্র গ্রন্থের উপর তাঁর আলোচনা ঐশ্বরিক ভাবে পরিপূর্ণ ছিল এবং তাঁর সেই স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা ছিল উৎকৃষ্ট এবং তাঁর বক্তৃতার সিরিজটি পরবর্তীতে বাংলায় " ভগবত কথা"  হিন্দি, গুজরাটি ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয় একই ভাবধারায় তিনি " শ্রী রামের অনুধ্যান" গ্রন্থটি রচনা করেন। পূজ্যপাদ স্বামী গীতানন্দজী মহারাজের দ্বারা রচিত " শ্রীরামের অনুধ্যান" ও " ভাগবত কথা"  বই দুটি রামকৃষ্ণ সংঘের ভক্ত মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। 

শ্রী সারদা দেবী বলতেন, " জপেই ভগবান কে লাভ করা যায়।" স্বামী গীতানন্দ মহারাজের জীবনে এই উক্তির সত্যতা পরিপূর্ণ হয়েছিল যা এই রামকৃষ্ণ সংঘের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে একটি বিশেষ চিহ্ন রেখে গেছে। শাস্ত্রজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে শ্রীমৎ স্বামী গীতানন্দজী মহারাজ তাঁর তপস্যাপুত সাধু জীবন সংঘের কাজে গভীর নিষ্ঠা ও মধুর স্বভাবের জন্য সকলের বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। কয়েক বছর ধরে বার্ধক্য জনিত অসুস্থতার পর পরমপূজ্য শ্রীমৎ স্বামী গীতানন্দজী মহারাজ ৯০ বছর বয়সে ২০১৪ সালের ১৪ ই মার্চ শুক্রবার সকাল ৯:৩০ মিনিটে  কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে মহাসমাধিলাভ করেন।অনুষ্ঠানে দূর - দূরান্ত থেকে ভক্তদের ঢল- আবেগ -উচ্ছ্বাস- শ্রদ্ধা ছিল বেশ দেখার মত।

Comments

Popular posts from this blog

মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সফলতা

কলকাতা হাইকোটের নির্দেশ অনুযায়ী ....