মধ্যযুগের শেষের দিকে বাংলার নারী সমাজ :-
কলমে:- বেবি চক্রবর্ত্তী- মধ্যযুগের সাহিত্য ভোগের আবিলতায় মন্থর। তখন অর্থের মানদণ্ডে সমাজে মানুষের মর্যাদা নিয়ন্ত্রিত হত। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস নষ্ট না হলেও তাতে ফাটল অবশ্যই ধরেছিল। বাঙালী গোষ্ঠীসর্বস্ব জীবন থেকে আত্মসর্বস্বতায় বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। যৌন-ব্যাভিচার, উৎকোচ, নৈতিক শৈথিল্য - মধ্যযুগের সাহিত্যে এই সবের বিপুল আয়োজন দেখতে পাওয়া যায়। সপ্তডিঙা ডুবে গেলে, চাঁদ বেণে চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তে বলেছিলেন, “চান্দো বলে অর্ধেক কড়ি বৈসায় খাইবো। আর অর্ধেক কড়ি আমি নটিরে বিলাইবো।” ভারতচন্দ্রের হীরার মুখে শুনতে পাওয়া গিয়েছিল, “বন্ধু নাহি কড়ি বই” কড়ি দিয়ে “বুড়োর বিয়ে হয়”, “কুলবধূ ভুলে কড়ি দিলে।” সেই সময়ের উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তির বিকৃত রুচির সদম্ভ প্রকাশ মানুষকে প্রচণ্ড অবক্ষয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। মঙ্গলকাব্যে নারী দেখলেই দেব-মানবের পরিধানের বস্ত্র শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল। কৌলীন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, সতীন নিয়ে ঘর, বৈধব্য প্রভৃতি নারী জীবনকে জর্জরিত করে তুলেছিল। নারীরা সেই সময়ের সামাজিক ব্যবস্থাকে অস্বীকার করতে পারছিলেন না। কিন্তু তাঁদের মনে ক্ষোভ বিক্ষোভ ফল্গুধারার মত প্রবাহিত হচ্ছিল। কারণ নারীরা তাঁদের যৌবন ও কর্তব্য দিয়ে ‘পুরুষ ভ্রমরা’ জাতিকে ধরে রাখতে পারছিলেন না। মাতৃহীনা মনসাকে ভাঙড় পিতা মহাদেব দেখেশুনে মুনিপুত্রের সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু “এক রাতি না কৈলাম বসতি”। এ তো সে যুগের শত শত কুলীন কুলবধূর মনের কথা। ক্ষোভের কথাও বটে। ভবানী, মনসা, চণ্ডীর সর্বত্র যাতায়াত ছিল। একমাত্র মধ্যবিত্তের জীবনে বাধা নিষেধের প্রাচীর গড়ে উঠেছিল। যখন নগর পোড়ে তখন দেবালয়ও তো রক্ষা পায়না। তাই তাঁরাও রক্ষা পাননি। মধ্যবিত্তের সমর্থ যুবতী বধূ বৃদ্ধ স্বামীর ঘর করেছিলেন বা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মনের যাতনায় তিনি বলেছিলেন, “আমি এই যুবতী আমার পতি বুড়া” বা “নৈলে নয় তেঁই করি কষ্টেতে শয়ন। রোগী যেন নিম খায় মুদিয়া নয়ন।” ওই সময়ের শাক্ত-পদাবলী বাল্য বিবাহ জনিত কন্যার জন্য মাতৃহৃদয়ের করুণ বিলাপে ভর্তি। যে দেহে মনে নারী হয়ে উঠতে পারেনি, বাল্যবিবাহের ফলে তাঁকে অকালে স্বামী, স্বামীগৃহ, সংসার ও পুত্রের সাধনা করতে হয়েছিল। সাধ্যের কথা সমাজে স্থান পায়নি। তখনকার সম্ভ্রান্ত ঘরের স্ত্রীদের সতীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অবকাশ ছিল। কবিকঙ্কনের চণ্ডীমঙ্গলে ধনপতি দূরদেশে যাবার আগে গর্ভাবতী খুল্লনাকে অপবাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ‘জয় পত্র' লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। অষ্টাদশ এবং ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজে পতিতার সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, “বেশ্যাগৃহের অশুদ্ধ উল্লাস ধ্বনি গৃহিণীগণের অন্তঃপুর মধ্যে প্রবেশ করিতেছে।” তখনকার পারিবারিক জীবনও খুব উচ্চাদর্শ দ্বারা চালিত হত না। ঘরে ঘরে স্বামী পরিত্যক্তা কুলীন কন্যা ও বিধবাদের ব্যভিচার প্রায় সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। কুলীন কন্যাদের নামেমাত্র বিবাহ হত এবং তাঁরাও বাল্যবিধবাদের মত পাপের পথে নেমে যেতেন। তবে সবচেয়ে বিপদের কথা ছিল, “তাঁহাদের সংসর্গদোষে পরিবারস্থ অনেকানেক সধবা স্ত্রীও তাঁহাদিগের অনুগামিনী হয়।” যে সব বিধবা বা কুলীন কন্যা শ্বশুরালয়ে, পিত্রালয়ে বা মাতুলালয়ে স্থান পেতেন না, যাঁদের ভাগ্যে গৃহস্থ বাড়ির পাচিকা বা দাসীবৃত্তিও জুটতো না, তাঁরা পতিতালয়ে স্থান পেতেন। অর্থাৎ সমাজে “অধর্ম ধর্মবৎ প্রচলিত হইতেছে।” পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা ও চিন্তাধারা বাঙালীর চিত্ত ভূমিকে স্পর্শ করে সমাজদেহে সঞ্চারিত হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গীয় জনগণ অবনত মস্তকে রঘুনন্দনের ব্যবস্থাকে শিরোধার্য করে নিয়েছিল। স্মার্ত রঘুনন্দন বাল্যবিবাহ, গৌরীদান প্রথার উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। বিবাহ ক্ষেত্রে বর্ণ, প্রবর, গোত্র, সপিণ্ড এবং কৌলীন্য অত্যধিক গুরুত্ব পেয়েছিল। রঘুনন্দনের একটি বিধান ছিল, “যদি কোন ব্যক্তি তিনবার বিবাহ করিয়া চতুর্থবার তাহা না করে সে আপনার সপ্তকূল পর্যন্ত নরকগামী করে।রঘুনন্দন সহমরণকে স্পষ্ট ভাষায় সমর্থন না করলেও, সহমরণে স্বর্গলাভের লোভ দেখিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বৈধব্য জীবনে ব্যভিচারিতা দোষ যাতে স্পর্শ না করে তারজন্য বিধবাদের সম্বন্ধে কঠোরতর ব্যবস্থার বিধান দিয়েছিলেন। বিধবা নারীর জন্য একাহার, একাদশী প্রভৃতি অবশ্য পালনীয় বলে বিধান দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হল, রঘুনন্দন আদৌ কি বাল্যবিধবাদের কথা ভেবেছিলেন? বঙ্গদেশে সেন রাজাদের শাসনকালে বল্লাল সেন গুণ দেখে কূল মর্যাদার ব্যবস্থা করেছিলেন।“দোষ অনুসারে কৈল কুলের সন্মান”) দেবীবর ঘটক দোষ দেখে কূল মর্যাদার ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম পাঠান অভিযানের পরে কণৌজিয়া ব্রাহ্মণ জাতির কন্যাদের পাঠানরা অপহরণ করেছিল। ফলে কণৌজিয়াদের মধ্যে নারীর অভাব দেখা দেওয়ায় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ কন্যাদের পাঠানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল। এতে হিন্দু সমাজ দোষ যুক্ত হয়েছিল। পাঠানীর গর্ভজাত সন্তান হিন্দুধর্মের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। দেবীবর মেল, পালটি, থাক প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে বিবাহক্ষেত্রে সামাজিক শুদ্ধির যে আয়োজন করেছিলেন তা পরবর্তীকালে রোটি-বেটির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেবীবর প্রণীত নিয়ম কুলীনকন্যাদের বিবাহ ব্যাপারে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। কুলীন পিতা ও শ্রোত্রিয় বঙ্গজ পিতা উভয়েই কুলীনকে কন্যা দিয়ে কূলরক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদা পেতে চাইতেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি অর্থাৎ পাত্রের তুলনায় কন্যা বেশি হওয়ায় পাত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে বহুবিবাহ সর্বজনীন হয়ে পড়েছিল এবং কাঞ্চনের প্রাধান্য দেখা দিয়েছিল। সেই সময়ের ইতিহাস ঘেঁটে এমন তথ্যও পাওয়া যায় যে, ৫৫ বছর বয়সী কুলীন পাত্র ১০৭ জন কুলীন কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন সমাজে বিধবারা অমঙ্গল ও অশুচির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। ফলে সামাজিক সব অনুষ্ঠানে তাঁদের বর্জন করা হয়েছিল। এর অনেক আগে, স্কন্দপুরাণে বিধবাজননী ব্যতীত আর সব বিধবাকে অমঙ্গলা বলা হয়েছিল। কিন্তু মধ্যযুগের শেষপাদে পৌঁছে জননীও রেহাই পাননি। এমন কি নিজের পুত্রের শুভ কার্যেও তাঁর উপস্থিতিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস বলে যে হিন্দুধর্মের প্রধান স্মৃতিকারেরা কিন্তু সতীদাহ সম্বন্ধে কখনো কোন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। শঙ্খ, অঙ্গীরা - সতীদাহকে সমর্থন করে, অজ্ঞ নারীদের সামনে অক্ষয় স্বর্গের প্রলোভন বিস্তার করেছিলেন। মিসেস স্পেয়ার গ্রন্থদ্বয়ে সতীদাহের বহু লোমহর্ষক চিত্র পাওয়া যায়। উলার জনৈক মুক্তারাম নামক ব্যক্তির তেরো জন স্ত্রী তাঁর সাথে সহমরণে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন পালাতে উদ্যত হলে পুত্ররা তাঁকে ধরে পিতার জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করেছিলেন। বাগনান পাড়ায় এক ব্রাহ্মণের একশত স্ত্রী ছিলেন। ১৭৯৮ সালে তাঁর মৃত্যুতে ৩৭ জন স্ত্রী সহমৃতা হয়েছিলেন। তিনদিন ধরে সেই নারকীয় মারণ যজ্ঞ চলেছিল। (নদীয়া কাহিনী, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ- ২৮৪) ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গদেশে প্রায় ৭০,০০০টি সতীদাহ হয়েছিল। ১৮১৫-২৩ সালের মধ্যে সতীদাহের ফলে ৫,১২৮ জন বালক বালিকা পিতৃমাতৃহীন হয়েছিলেন। (Asiatic Journal, 1827, Vol. XXIII, p- 689) সমাচার দর্পণ পত্রিকা থেকে জানা যায় যে, “হিন্দুস্থানে যত সহমরণ হয় তাহার সাত অংশের একাংশ কেবল জেলা হুগলীতে হয়।” সেই হুগলী জেলাতেই রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হয়েছিল। একটা সময়ে সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকেরা এবং যোগী সম্প্রদায়ের মধ্যেও সতীকে স্বামীর সঙ্গে জীবন্ত সমাধি দেওয়া শুরু হয়েছিল। ১৮২৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে প্রকাশিত সমাচার দর্পণ পত্রিকা থেকে সেই সংবাদ পাওয়া যায়। আর্নেস্টরিস লিথিত কেরীর জীবনীতেও এব উল্লেখ আছে। ইষ্ট ইণ্ডিয়া হাউসে সতীদাহ রদ নিয়ে বিতর্কের সময় সতীকে জীবন্ত সমাধি দেবার বহু ঘটনা উল্লেখিত হয়েছিল। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল, কেতকা দাস ক্ষেমানন্দেব মনসামঙ্গলে, মানিকচন্দ্রের গানে, ঘনারাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে সহমরণের চিত্র পাওয়া যায়।
মধ্যযুগের সাহিত্যে দেখা গিয়েছিল যে নারী ‘স্বতন্তরা’ হতে চলেছে। দেবদেবীর বন্দনা, কাঁচুলি নির্মাণ, বারমাস্যা প্রভৃতির মত ‘কলির বর্ণনা’ এবং নারীর স্বভাব ও কালধর্মের বর্ণনা সেই সময়ের সাহিত্যে বিশেষ স্থান পেয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যে চণ্ডীদাস নারীদের সম্বন্ধে বলেছিলেন -
“সেবকেঁ লংঘিবে প্ৰভু নারী নিজ পতি।
আপনা মজায়িব ব্রত লংঘিআসতী॥”
(শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ভারখণ্ড, সাহিত্য পরিষৎ, পৃ- ৬৮)
কেতকাদাস-ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গলে লেখা হয়েছিল (মনসামঙ্গল, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, পৃ: ৩৫০-৫১) -
“পরহিংসা পরদার।
পরদ্রব্যে মতি যার।
কলিতে হৈব তাহার উন্নতি॥
….
পুরুষেরা বশ হৈব।
অবলা প্রবল হৈব।
স্ত্রী হইব কলির দেবতা॥
…
অষ্টম বৎসরের বালা।
গর্ভবতী রজঃ স্বলা।
ষোড়শ বৎসৱে হৈব জরা॥”
বলরাম কবিশেখর রচিত কালিকামঙ্গল গ্রন্থে লেখা হয়েছিল (কালিকামঙ্গল, বলরাম কবিশেখর, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ) -
“যার ধন হব সেই হব কূলবতী।
পতিনিন্দা করিবেক যতেক যুবতী॥
…
কুলবধূ ছাড়িবে যতেক কুলধর্ম।
নারীর বচন পুরুষের হবে ব্রহ্ম॥”
নিত্যানন্দ দাস তাঁর প্রেমবিলাস গ্রন্থে লিখেছিলেন - “কলি যুগের লোক সব বড় দুরাচার।” জমিদার কান্দরায় সম্বন্ধে অষ্টাদশ বিলাসে বলা হয়েছিল -
“শক্তি উপাসনা সদা মদ্য মাংস খায়।
পরস্ত্রী ঘর দ্বার লুটি লঞা যায়॥”
“সবে স্ত্রী লম্পট জাতি বিচার রহিত।
মদ্য মাংস বিনা না ভুঞ্জয়ে কদাচিত॥”
ঘনারাম চক্রবর্তী লিখিত ধর্মমঙ্গল গ্রন্থে লেখা হয়েছিল (ধর্মমঙ্গল, ঘনরাম চক্রবর্তী, বঙ্গবাসী, ২য় সংস্করণ, ১৩০৮ বঙ্গাব্দ) -
“না বুঝিয়া তত্ত্ব। পরদারে মত্ত। মজাইবে মাংস মদে।
…
ত্যাজি নিজপতি। সতী কূলবতী। যুবতী অসৎ হবে॥
মদন আবেশে। পরপতি আসে। পথ আগুলিয়া রবে৷
যতেক অবলা। সে হবে প্রবলা। কথা কবে হাত নেড়ে।
স্বামীর বচন। করিবে লঙ্ঘন। গঞ্জনায় দিবে তেড়ে॥”
গঙ্গারাম লিখিত মহারাষ্ট্র পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছিল (মহারাষ্ট্র পুরাণ, গঙ্গারাম, ১ম খণ্ড) -
“রাধাকৃষ্ণ নাহি ভজে পাপমতি হইয়া।
রাত্রিদিন ক্রীড়া করে পরস্ত্রী লইঞা।
শৃঙ্গার কৌতুকে জিব থাকে সর্বক্ষণ।”
শাক্তনন্দ তরঙ্গিনী রচিত ষোড়শোল্লাস গ্রন্থে কলিকালের বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছিল (শাক্তনন্দ তরঙ্গিনী, প্রসন্নকুমার শাস্ত্রী ভট্টাচার্য অনূদিত, ৩য় সংস্করণ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ-
কলিকালে মহেশানি পাষণ্ডা বহবো জনাঃ।
সঙ্গদোষা-মহেশানি তৎক্ষণাৎ হাণিতাং ব্ৰজেত।
তস্মাৎ প্রযত্নতো দেবি সংসর্গঃ বর্জয়েৎ সুধীঃ।
ভারতে বহবো দোষা কলিকালে সুরাচ্চিতে।
ব্রাহ্মণা: কলিকালে তু শূদ্রগেহে বরাঙ্গনে।
…
পরস্ত্রী সঙ্গমাচ্চৈব পুত্রমুৎ পাদষন্তি চ।
আত্মানং বৈষ্ণবৎ সত্বা অধম্ ভারতে কলৌ।
…
কলিকালে ভারতে চ ব্রাহ্মণী গীততৎপরা।
সদা বাদ্যরতা ভূত্বা নৃত্যন্তি ব্রাহ্মণাধমা।”
সেই যুগে নারীরা আর শাস্ত্রের বচন মানছিলেন না। পলাশীর যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই বাঙালীর চারিত্রিক অবনতি প্রকট হয়ে পড়েছিল। যে সমাজে পুরুষের নীতি, চরিত্র, মনুষ্যত্বের কোন মূল্য থাকে না, লোভ-লালসা সমাজের শুভবুদ্ধিকে গ্রাস করে, সেখানে নারীর আলাদা মর্যাদা, জীবনবোধ ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। ভারতচন্দ্রের কাব্য সেযুগের এক ঐতিহাসিক দলিল। ভারতচন্দ্রে কেবল মুসলমান শাসনের অন্তিমকালই ঘোষিত হয়নি, মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থারও অন্তিমকাল ঘোষিত হয়েছিল। সেই সময়ের নারীরা অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের কাঠগড়ায় ভাগ্যকে সাক্ষী করে সব কিছু মেনে নিতে পারেন নি। সামাজিক বঞ্চনা, স্বামী নির্যাতন, কৌলিন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, বাল্যবৈধব্য, যৌথ পরিবারের ‘বাঘিনী সতিনী’, ‘রাগিনী শাশুড়ী’ ও ‘ননদী-নাগিনী’-র বিষভরা দন্তের কামড়ে তাঁরা জর্জরিত হয়ে উঠেছিলেন। তাই সেই সময়ের পুরুষ বলেছিল,
“নারী যার স্বতন্তরা।
সেজন জীয়ন্তে মরা।
তাহার উচিত বনবাস।”
(ভরতচন্দ্রের অনুদামঙ্গল, বসুমতী)
পুরুষের সোহাগের আলাপের উত্তরে নারী বলেছিল -
“সোহাগে এমন কথা পুরুষেরা কয়॥
নারীর পতির প্রতি বাসনা যেমন।
পতির নারীর প্রতি মনকি তেমন।
পাইতে পতির অঙ্গ নারী সাদ করে৷
তারি সাক্ষী মৃতপতি সঙ্গে পুড়ে মরে॥
অর্ধঅঙ্গ যদি মোর অঙ্গে মিলাইবে।
কুচনীর বাড়ী তবে কেমনে যাইবে।”
(ভরতচন্দ্রের অনুদামঙ্গল, বসুমতী)
নারী সেই সময়ের দূষিত সমাজের সব গরল পান করেছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যে নারীচরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করেই করুণরস নিরতিশয় করুণ হয়ে উঠেছিল।
ইতিহাসের বিখ্যাত পলাশীর যুদ্ধ রাজনৈতিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলেও সামাজিক ক্ষেত্রে সেটা বিশেষ কোন পরিবর্তন আনেনি। কারণ, দেশের নতুন শাসন ব্যবস্থায় যে সব ইংরেজদের দেখা গিয়েছিল, তাঁরা কিন্তু খুব উচ্চ আদর্শের দ্বারা চালিত ছিলেন না। ভারতীয়দের মত তাঁরাও অনন্ত ভোগবিলাসের মধ্যে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের কোন সংস্কৃতি ছিল না। জীবন উপভোগ বলতে তাঁরা স্থূল ব্যাপার বুঝতেন। “Christianity was looked upon by the natives of Hindoosthan only as another name for irreligion and immorality.” (Calcutta Review, 1834, Vol. I, p- 293) রাজনারায়ণ বসু বলেছিলেন, “সেকালের সাহেবরা অর্ধেক হিন্দু ছিল।” (সেকাল ও একাল, রাজনারায়ণ বসু, পৃ- ৩) তাঁরা কালী মন্দিরে ভেট পাঠাতেন, বাইজীর নাচ দেখতেন, খানাপিনার আয়োজন করতেন। তখন লুঠতরাজ ও রাহাজানি কেবলমাত্র দেশীয় দুষ্কৃতকারীরাই করতো না। ইংরেজরাও মাঝরাতে অন্যের গৃহে প্রবেশ করে ইংরেজ মহিলার উপরে অত্যাচার করে তাঁর দাস-দাসী নিয়ে পালিয়ে যেত। (Calcutta Gazettee, 1781, 152th Jan) আবার অবিবাহিত ইংরেজ তরুণ তরুণীরা বল-নৃত্যে খানাপিনার আয়োজন করতেন এবং সেখানে সবাই মুখোশ পরে নাচের নামে যথেচ্ছাচার করতেন। (Hicky's Gazettee, 1780, 15th August) সেই সময়ের কলকাতায় ইংরাজরা কেবল দাসদাসীর ব্যবসাই করতেন না, “... there were Englishmen in Calcutta little more than a hundred years ago who not only bought and sold African slaves, but also for the breeding of them for the slave market.” (Calcutta Gazettee, 1817, 2nd Jan) বঙ্গদেশে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্ব লাভের পরে দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয়ের ফলাও বাজার তৈরী হয়েছিল। ইংরেজরা এ দেশীয় ও আফ্রিকান নারীদের নিয়ে ভোগ বিলাসে ডুবে থাকতেন। (Echos from Old Calcutta, H. E. Busteed, C.I.E., 1908, p- 136) এই বিষয়ের বহু নিদর্শন সে কালের সংবাদ পত্র থেকে পাওয়া যায়। ইংরেজদের অবৈধ সন্তানেরা এই দেশের সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তাই শেষে ইংরেজ নারীদের এদেশে আমদানি করবার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। (Slavery Days, H. A. Stark, B.A., p- 2) বঙ্গদেশে লর্ড কর্ণওয়ালিসের আবির্ভাবের পর থেকে ইংরেজদের মধ্যে পরিশীলিত জীবনবোধ, রুচি এবং দর্শনের আবির্ভাব ঘটেছিল। “Cornwallis brought with him to India all the finest characteristics of a highly-minded English nobleman.” (Asiatic Journal, Vol. III, 1817, p- 108) ১৮২৫-৩০ সালের পর থেকে অবস্থার আরও পরিবর্তন ঘটেছিল। “Steam has done much to bring about this intellectual revolution. We are no longer isolated savages.” (Calcutta Review, 1843, Vol. I, p- 293) ঊনিশ শতকে নারীর প্রতি সম্ভ্রম জাগানোর জন্য জাতীয় নবজাগরণের প্রয়োজন ছিল। অথচ ইংরেজরা যখন এদেশে এসেছিল তখনও ইউরোপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন হয়নি। ইউরোপেও সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ধনীরা কন্যা ক্রয় করে নিজের পুত্রদের বিবাহ দিতেন। স্বল্পবিত্তবানদের ছেলেরা পণ নিতেন। সম্পন্ন গৃহের মেয়েদের কন্ভেন্ট হাউসে পাঠিয়ে দেওয়া হত। সেখানে তাঁরা সন্ন্যাসিনীর জীবন যাপন করতেন। সেই কন্ভেন্টগুলো ছিল নরক। খ্রিস্টান যাজকরা পাপাচারে ডুবে গিয়েছিলেন। কনভেন্ট গুলোতে ‘House of correction’ এবং ‘Madhouse’ ছিল। “I know but one difference between them; whilst the houses of correction are inspected by the law, and the mad houses by the police, both stop at the convent doors; the law is afraid, and the police dares not pass the threshold.”. (Calcutta Review, 1848, Vol. I, p- 202) সেই সময়ের বঙ্গদেশের প্রধান শহর - কলকাতা, বর্ধমান, কৃষ্ণনগর ও ঢাকা - লাম্পট্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। বাইরে কেঁচোর পত্তন ও ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন চলছিল। সেই ব্যভিচারের স্রোত গৃহ ও গৃহস্থকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। গৃহবধূ ও ললনারা তা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেন নি। অথচ সব কিছুই হয়েছিল ধর্মের নামাবলির আড়ালে। “Hinduism in Bengal had these two aspects, the Vaishnava and the Tantrika, and in both those aspects Hinduism was rotten to the core. A great revolution, a protest was at hand.” (Priests, Women and Families, J. Michelet, Translated by C. Cooks, 1846, p- 64) সামাজিক বিপ্লব এবং বলিষ্ঠ প্রতিবাদের জন্য চাই নৈতিক বল ও চারিত্রিক সামর্থ। ইউরোপে নারী মুক্তি আন্দোলন দানা বেঁধে না ওঠা পর্যন্ত দেশী ও বিদেশীদের নানা প্রয়াস থাকলেও তা কার্যকরী হয়নি। কেননা তখনও ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক ও দার্শনিক উপলব্ধি ঘটেনি। রামমোহন এবং তাঁর সহচর, হিন্দু ও হেয়ার স্কুলের ছাত্ররা যে সব সভাসমিতি গঠন করেছিলেন তা কোন মজলিসের আসর ছিল না। সেই সভাসমিতির মধ্য দিয়ে তাঁরা দেশের ও নারীদের প্রকৃত সমস্যা বুঝতে ও জনসাধারণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন।
Comments
Post a Comment