স্বরাজ আমার সাধনা নিরবে বলি নেতাজি :-
এই স্বদেশের কাছ থেকে আমরা সব পেয়েছি -------- জীবন, আহার, বন্ধু, পরিজন, শ্রদ্ধা। এই দেশ কি আমাদের প্রকৃত জননী নয় ? কথাগুলির মধ্যে এই দেশের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। ভারত তাদের কাছে কি প্রত্যাশা করে -- প্রথম কর্তব্য আহার ও সুনিদ্রার প্রতি মনোযোগ, দ্বিতীয় কর্তব্য খেলাধূলায় যোগদান। তারা যে শিক্ষালাভ করছে, তাতে এক বিদেশি ভাষা আয়ত্ব করতেই অর্ধেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়। স্বামীজির এই জ্বালাময়ী উক্তিই বাংলার যুবকদের হৃদয়ে স্বদেশিকতা জাগিয়ে তুলেছিল। সেদিন এটাই ছিল বিপ্লবের গোড়ার কথা। নবীন ভারতকে প্রধানত তিন দিক দিয়ে তিনি স্বদেশসেবায় দীক্ষা দিয়েছিলেন। প্রথমত ----কর্মযোগ। বলেছিলেন 'রাজগুণ ও কর্মযোগ না হলে এই জীবন্মৃত জাতি বাঁচবে না।' দ্বিতীয়ত ---- ত্যাগ ও সেবা সাধনা। তৃতীয়ত ---- ছুঁৎমার্গ পরিহার করা। স্বামীজির এই আহ্বানে ঘুমন্ত জাতি সাড়া দিয়েছিল। তিনি জাতিকে নব জীবনের পথ দেখিয়েছিলেন।
তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানুষের জন্য মানুষের, সম্প্রদায়ের জন্য সম্প্রদায়ের, জাতির জন্য জাতির অগ্নিময় সহানুভূতিই শুধু ভেদবুদ্ধিতে জর্জরিত পৃথিবীকে কল্যাণের স্বর্গে পৌঁছে দিতে পারে না। জীবনের অর্থ উন্নতি, উন্নতির অর্থ হৃদয়ের বিস্তার ও প্রেম একই কথা। ভারতমাতার প্রতি ভালোবাসা আর স্বার্থপরতাই মৃত্যু। জীবন থাকতেও তা মৃত্যু আর দেহাবসানে ও এই স্বার্থপরতাই প্রকৃত মৃত্যুস্বরূপ। সমস্ত মানুষকে ভালোবাসা, সমস্ত মানবজাতিকে আত্মার আত্মীয় বলে অনুভব করা --- এটাই স্বামীজির জীবন দর্শন। যা সুভাষচন্দ্র বসু সমগ্র ভারতবাসী মানবধর্ম ত্যাগ ও কর্মের প্রতিটা পদক্ষেপে উপলব্ধির সার্থকতা দেখিয়েছিলেন। "ন্যায়ের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বা যুদ্ধ করা।" নিরিহ ব্রিটিশ শাসকরা যেন এদেশে মানবসেবা করতে এসেছিলেন। তিনি আপোষহীন কর্মসূচিতে বিশ্বাসী নন। কিছুটা গান্ধীজি - জহরলাল নেহরুর মত গোলামি চাটুকারিতার পক্ষপাতিত্ব একদমই ছিলেন না।একের পর এক বাংলায় অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসর্ফোড, লেমান, কেগ, গার্লিক, পেডি,সেনসন্, চার্লস টেগার্ট, হান্ডিজ, এন্ডুজ এন্ডারসন, ম্যাজিস্ট্রেট ডাগলাস এদের অকথ্য অত্যাচারে বহু বীর-বীরাঙ্গনা বিপ্লবীদের মৃত্যু হয়।
'স্বাধীনতা' এক শক্তি'র উন্মেশ এই উন্মেশকে জাগ্রত করতে গেলে যুব ভারতকে জাগ্রত করতে হবে, বিশ্বাস জাগানোর মতো প্রেরণা দিতে হবে ভারতবাসীকে। শহীদে'র রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা তিনি বলেছিলেন ব্রিটিশ বণিক শাসিত ভারতে তখন অত্যাচার চরমে ছিল বাংলায় যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছিলেন কিছু কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী ব্রিটিশদের সাথে আপশের রাজনীতির করছিলেন সেই সময় নেতাজি বলেছিলেন ব্রিটিশদের সাথে ভারতীয়দের লড়াইয়ে ভারতবাসীর আদও কোনো মঙ্গল হবে না। গান্ধীজি, জহরলাল নেহেরুর মতো যে সব কংগ্রেস নেতারা দরকষাকষি করতেন তাতে সায় ছিল না নেতাজীর। ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন পরিবর্তন আলোচনার মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ' অহিংসা এবং 'আলোচনার' মাধ্যমে স্বাধীনতা এসেছে এনিয়ে চরম বিতর্কের মুখে জড়িয়ে পড়তেন। তিনি মনে করতেন হিংসা মানে যে অপরাধ মূলক তা নয়। আর সেই অপরাধ যদি বৃহত্তর- স্বার্থের পরিপূরক হয়। আর অন্তঃআত্মা সেই অপরাধ করার জন্য যদি ডাক দেয় তাহলে পিছু হটার জায়গা নেই।
"তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব " এই মর্মে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ৪ ঠা জুলাই সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সভায় রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রের হাতে ' ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ' এর সকল দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। ২৫ শে আগস্ট সুভাষচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ্ হিন্দ বাহিনী-র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং সেনাবাহিনীর আমূল পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। দলে দলে হিন্দুমুসলিম, নারী- পুরুষ ও বালকবালিকা এই সেনাদলে যোগদান করেছিলেন। শ্রীমতী লক্ষ্মী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে নারীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল 'ঝাঁসীর রানি ব্রিগেড' । এছাড়াও জি. এস. ধীলন ও পি. কে. সায়গল ছিলেন আজাদ্ হিন্দ বাহিনীর দুই বিশিষ্ট সেনাধ্যক্ষ। নেতাজির আহ্বানে প্রবাসী ভারতীয়রা মুক্তহস্তে যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। আজাদ্ হিন্দ বাহিনীতে প্রায় ৮৫ হাজার স্বর্ণ ছিল। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২১ শে অক্টোবর নেতাজি সিঙ্গাপুরে 'আজাদ্ হিন্দ সরকার' বা স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। ২৩ শে অক্টোবর আজাদ্ হিন্দ সরকার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই জাপান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি প্রভৃতি পৃথিবীর নয়টি রাষ্ট্র এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। ৬ ই নভেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি আজাদ্ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেন। ৩১ শে ডিসেম্বর নেতাজি এই দুটি দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন যথাক্রমে 'শহিদ' ও 'স্বরাজ'। সারা দেশ জুড়ে পালিত 'আজাদ্ হিন্দ সপ্তাহ' এবং 'আজাদ্ হিন্দ দিবস্'। দেশের নানা স্থানে 'আজাদ্ হিন্দ ফৌজ প্রতিরক্ষা তহবিল, 'আজাদ্ হিন্দ ফৌজ পতাকা দিবস' প্রভৃতি ছড়াছড়ি পড়ে যায়। ' জয় হিন্দ', ' দিল্লি চলো' আজাদ্ হিন্দ সেনাদের মুক্তি চাই, 'লাল কেল্লা ভেঙে ফেলো' ধ্বনিতে ভারতের আকাশ - বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
সমগ্র ভারতবাসীর প্রাণের নেতা জাতির নেতা নেতাজি। জহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রীত্ব থাকাকালীন তাঁর "মৃত্যুর রহস্য" আজও ভেদ করতে পারেনি এ আমাদের কাছে লজ্জার! রাইসিনা হিলসে্র সিংহাসনে কত রাজা এল আর গেল কিন্তু...." নেতাজি আজও জীবিত না মৃত! নেতাজির রহস্য জনক মৃত্যু" না কেও এই বিষয়ে আলোকপাত করেছে। ভয় না সংঘাত তা সাধারণ মানুষ জানতে চায়..!! আজও এর উত্তর যেন দাঁড়িয়ে সমীক্ষায়।
হায় রে বাঙালি! এত শ্রীঘ্র সুভাষচন্দ্র বসুর ত্যাগের কথা ভুলিয়াছ?
" আমি কংগ্রেসের কাজ ছাড়তে পারি --------- তবুও সেবাশ্রমের কাজ ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব।' দারিদ্র নারায়ণের সেবায় এমন প্রকৃষ্ট সুযোগ আমি কোথায় পাইব। এখানে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা প্রচারিত দারিদ্রনারায়ণ সেবার কথা সুভাষের মনে -প্রাণে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলেছিল।
অনেকেই মনে করেন দেশে ভাগের যে দ্বি-চারিতা তা সাধারণ জনগণের কোনো দোষ নেই । সাধারণ জনগণ ছিল তাঁদের হাতের পুতুল। অখন্ড ভারতের বিভক্ত "পাকিস্তান -ভারত- বাংলাদেশ - কাশ্মীর" এই মাতৃভূমির ওপর দ্বি - চারিতা আজীবন জিইয়ে রাখারই কৌশল জল্লাদের মত ভূমিকা পালন করেন স্বাধীন ভারতের গভর্নর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। আর সেই বলির পাঁঠা হয়েছিলেন দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জিন্না - জহরলাল নেহরু ।
মধ্যরাত্রির অন্ধকারে আমরা যে স্বায়ত্বশাসন বা ক্ষমতা হস্তান্তর পেয়েছি। এই স্বায়ত্বশাসনের প্রকৃত অর্থ হল মালিক বা প্রভু আপনারা (ব্রিটিশ শাসক) আর আমরা আপনার কর্মচারী।
"মাতৃভূমির পূজা " -- ভগবান -ঈশ্বর - আল্লাহ বাসস্থান তোমার মনের মন্দিরে। ধর্ম মানে শুধু সম্প্রদায় স্বীকৃতি নয় জাতির উন্নতি। উৎসব হল আনন্দভূমি মিলনস্থল। সেই উৎসবে কোটি কোটি টাকা আমোদ -প্রমোদ । এই কোটি টাকা নিয়ে রাজপ্রসাদ ও বানানো যায়। কিন্তু এই কোটি টাকার একটা অংশ দিয়ে এই খোলা আকাশের নিচে ঝড়- বৃষ্টি -বাদল-শীত উপেক্ষা করে রাত্রিরত গরিব অসহায় মানুষের যদি সেবা করা যায়। নিরবে নিভৃতে ভারত ভূমির অসহায় মানুষের চোখের জলের কিছুটাও আমারা ভাগিদার রাখি।
Comments
Post a Comment