ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কলকাতা, ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ। ভ্রমণপিপাসু রবীন্দ্রনাথের ইউরোপে থাকাকালীন সময়ে রচিত গান ও পাঠের সংকলন। তিনটি সিডির একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে ভাবনা। পরিকল্পনা, গ্রন্থনা, পরিচালনা ও সংগীতে বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী লিলি ইসলাম। সমবেত সংগীত পরিবেশন করেছেন লিলি ইসলামের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান উত্তরায়ণ। অ্যালবামটি শুরু হয়েছে গীতবিতানের ভূমিকা প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে গানটি দিয়ে। এরপরে রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে রচিত ৩০ টি গান। অ্যালবামটির সহ পরিচালনায় রয়েছেন হিমাদ্রী শেখর, যন্ত্রায়োজনে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গানই শুধু নয় তাঁর রচনার প্রেক্ষাপট সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে লিলি ইসলামের উত্তরায়ণ সবসময় বিষয়বিত্তিক গানের অনুষ্ঠান পরিবেশন করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রযোজনা ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ।
লিলি ইসলাম দুই বাংলার সংগীত প্রেমীদের কাছে যথেষ্ট পরিচিত একটি নাম। তিনি একান্নবর্তী পরিবারে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যে জন্ম নিয়েছেন এবং বেড়ে উঠেছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা তাদের পরিবারের একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। লিলির প্রথম গান শেখা শুরু হয় তার মায়ের কাছে। মা অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী ছিলেন। খুব ছোটবেলাতেই মা লিলিকে গীতবিতানে ভর্তি করিয়ে দেন। পরমশ্রদ্ধেয় সংগীতগুরু গীতা রক্ষিত, কমলা বসু, গোপাল পাত্র, নিহারবিন্দু সেন এঁদের কাছে গান শেখার সুযোগ হয়েছিল তার। গীতবিতানের পর লিলি কিছুদিন শিখেছিলেন শিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর কাছে শিখতে শিখতে তিনি শান্তিনিকেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন সত্যিকার অর্থে বাস্তবে রূপ পেল এতদিনে। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি সংগীত ভবনের ছাত্রী ছিলেন এবং রবীন্দ্রসংগীতে এম. মিউজ সম্পন্ন করেন। শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, গুরুদের স্নেহ-আশীর্বাদ, তাঁদের শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি লিলির জীবনধারাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়। তিনি নতুনভাবে সবকিছু ভাবতে শুরু করেন, বুঝতে শেখেন, অনুভব করতে শেখেন । লিলির গুরু ছিলেন পরমশ্রদ্ধেয় শিল্পী কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, গোরা সর্বাধিকারী, অশোক গাঙ্গুলী, অরূপরতন বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহন সিং, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। তার নৃত্য গুরু ছিলেন ভরতনাট্যমে কলামান্ডলম শঙ্করনারায়ণ এবং মণিপুরীতে গুরু জীতেন সিং। তিনি অভিনয় শিখেছেন শ্রী পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ে কাছ থেকে। লিলি নতুন নতুন শিক্ষায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন সায়া।প্রতিনিয়ত। শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে গুরুদেবের যে আশীর্বাদ বাণী ছড়িয়ে রয়েছে, যে সুর ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে ধারণ করতে চেষ্টা করেছিলেন। শুরুদের স্নেহধন্য হয়েছিলেন এ তার পরম সৌভাগ্য। তাঁদের প্রতি লিলি ইসলামের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। লিলি তার মা বাবার কাছে যতখানি ঋনী ঠিক ততখানি ঋনী তার গুরুদের কাছে, সর্বোপরি ঈশ্বরের কাছে। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন প্রতিটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে তার গুরুরা তাকে ধন্য করেছেন। লিলি তাঁদের কাছ থেকে শুধুই যে গান-নাচ শিখেছেন তা নয়, একজন সত্যিকার অর্থে মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন মানুষ হতেও শিখেছেন। তাঁদের শিক্ষাকে ধারণ করে লালন করে লিলির পথ চলা শুরু হয়েছিল। এরপরে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ আরো তিনটি বছর তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন একটি গবেষণায় কাজ করার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত তিনি কাজটি শেষ করতে পারেননি। ১১ বছরের শান্তিনিকেতনের জীবনে তার অনেক মধুর স্মৃতি যেমন আছে তিক্ত অভিজ্ঞতাও তেমন আছে। কিন্তু সেই তিক্ততাকে তিনি দূরে সরিয়ে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন সর্বদা। এও তার মা বাবা এবং গুরুদের শিক্ষা।বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেন গানের ভুবনে। গান শেখানো এবং গান গাওয়া দুটোই সমানভাবে তার চলতে থাকে। লিলি দেশে এবং বিদেশে বহু অনুষ্ঠান করে মানুষের যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছেন। কলকাতা এবং বাংলাদেশ থেকে তার ১৭ টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। ২০০২ সাল থেকে তিনি যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম ডিজাইন ইউনিভার্সিটি শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির সংগীত বিভাগে। এখন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক।কাজ করেছে যে সব শিক্ষার্থী
সাধারণ মানের তাদের তালিমের জায়গাটি নিশ্চিত করা - এবং মঞ্চে গান গাইবার সুযোগ করে
দেওয়া। প্রতি বছর উত্তরায়ণ এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি যে উৎসব করেন সেখানে বিষয়ভিত্তিক
অনুষ্ঠান পরিবেশন করে থাকেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি সেই গানের প্রেক্ষাপটকে
তিনি যদি তুলে ধরতে না পারেন তাহলে গানটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই ভাবনা থেকেই লিলি
ইসলাম শুরু করেন বিষয়ভিত্তিক গানের অনুষ্ঠান করা। তারই ধারাবাহিকতায় উত্তরায়ণ এর
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে তার এই নিবেদন ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ।
গানগুলি হল
গান (১) সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি (১৯১২, ২৫ জুন) লন্ডন, (২) গান : এ মণিহার আমায় নাহি সাজে (১৯১৩, ২৪ আগস্ট) লন্ডন,
(৩) গান : তোমারি নাম বলব নানা ছলে (১৯১৩, ২৪ আগস্ট) লন্ডন, (৪) গান: অসীম ধন তো আছে তোমার (১৯১৩, ২৪ আগস্ট) লন্ডন, (৫) গানঃ প্রাণে খুশির তুফান (১৯১৩, ২৫ আগস্ট) লন্ডন, (৬) গান: ভোরের বেলা
কখন (১৯১৩, ২৫ আগস্ট), লন্ডন, (৭) গান : জীবন যখন ছিল
ফুলের মত (১৯১৩, ২৭ আগস্ট) লন্ডন, (৮) গান : কার চোখের
চাওয়ার হাওয়ায় (১৯২৬, ৯ সেপ্টেম্বর) হামবুর্গ, (৯) গান: রয় যে কাঙাল শূন্য হাতে (১৯২৬, ১০ সেপ্টেম্বর) হামবুর্গ,
(১০) গান : ছুটির বাঁশি বাজল (১৯২৬, ১৭ সেপ্টেম্বর) মিউনিখ, (১১) গান: নাই নাই ভয় (১৯২৬, ১৮ সেপ্টেম্বর) মিউনিখ, (১২) গান : তোর ভিতরে
জাগিয়া কে (১৯২৬, ১৮ সেপ্টেম্বর) মিউনিখ, (১৩) গান : আমার
মুক্তি আলোয় আলোয় (১৯২৬, ১৯ সেপ্টেম্বর) ন্যুববর্গ, (১৪) গান : সকাল বেলার আলোয় বাজে (১৯২৬, ২০ সেপ্টেম্বর) ন্যুনবর্গ,
(১৫) গান : মধুর তোমার শেষ যে না পাই (১৯২৬, ২১ সেপ্টেম্বর) স্টুটগার্ট,
(১৬) গান : তুমি ঊষার সোনার বিন্দু (১৯২৬, ২৪ সেপ্টেম্বর) কলোন, (১৭) গান : চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে (১৯২৬, ২৪ সেপ্টেম্বর) কলোন,
(১৮) গান : আপন গানের টানে তোমার পাঠান্তর গানে গানে তব বন্ধন
যাক (১৯২৬, ২৫সেপ্টেম্বর) ড্যুসেলডর্ফ, (১৯) গান : আপনি
আমার কোনখানে (১৯২৬, ৬ অক্টোবর) বার্লিন, (২০) গান : ওগো সুন্দর, একদা (১৯২৬, ১১ অক্টোবর) গ্রা, (২১) গান : কোথায় ফিরিস পরম শেষের (১৯২৬, ১২ অক্টোবর) গ্রাগ্
(২২) গান : আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি (১৯২৬, ২০ অক্টোবর) ভিয়েনা
অস্ট্রিয়া, (২৩) গান : পথ এখনো শেষ হল না (১৯২৬, ২৭
অক্টোবর) বুদাপেষ্ট, (২৪) গান : দিনের বেলায় বাঁশি তোমার (১৯২৬,
৩০ অক্টোবর) বুদাপেষ্ট, (২৫) গান : ক্ষত যত ক্ষতি যত (১৯২৬, ১৫
নভেম্বর) সিরিউস সায়া, (২৬) গান : অরূপ তোমার বাণী (১৯২৬, ২১ নভেম্বর)
বুখারেস্ট, (২৭) গান : বাঁশি আমি
বাজাই নি (১৯২৬, ২৪ নভেম্বর) দার্দানেলিস, (২৮) গান : যা পেয়েছি
প্রথম দিনে (১৯২৬, ২৫ নভেম্বর) সিরিউস,
গানগুলির অধিকাংশই লেখা হয়েছে
১৯২৬ সালে। কয়েকটি গান পাওয়া গেছে ১৯১২ এবং ১৯১৩ সালে আর দুটি গান পাওয়া গেছে ১৯৭৯
সালে। ইউরোপে ভ্রমণকালীন পথে তিনি বহু গান রচনা করেছেন সেই গানগুলিকে এই অ্যালবামের
অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।
লিলি ইসলাম আরো বলেন হিমালয়
পর্বতের মত যার উচ্চতা সমুদ্রের মত যাঁর গভীরতা সেই মানুষটির সৃষ্টির বিশাল ভান্ডারকে
উপস্থাপন করা অত্যন্ত দুরূহ। তিনি শুধু চেষ্টা করেছেন মাত্র। এই নিবেদন তাদের একটি
ক্ষুদ্র প্রয়াস। ভাবনার কর্ণধার শ্রী বিশ্ব রায় ও এর সঙ্গে যারা রয়েছেন তাদের সকলকে
লিলি ইসলাম ও উত্তরায়ণের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
Comments
Post a Comment